হারিয়ে যাওয়া ১০০ জনকে পরিবার খুঁজে দেবো: আর জে কিবরিয়া
প্রকাশিত: ০৬ জুলাই ২০২০, ১৭:০১
বাংলাদেশের এফএম রেডিও জকিদের (সঞ্চালক) মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুপরিচিত নাম আর. জে. কিবরিয়া। যার প্রকৃত নাম মো. গোলাম কিবরিয়া সরকার। ২০০৬ সালে রেডিও টুডেতে কথাবন্ধু হিসেবে যোগ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। শ্রোতাদের পছন্দের এই মানুষটি একই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ১৪ বছর। বর্তমানে রেডিও আম্বারের স্টেশন ইনচার্জ, ঢাকা এফএম-এর এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে কর্মরত। সবসময় জীবনঘনিষ্ঠ অনুষ্ঠান করেন তিনি।
তার সঞ্চালিত ‘জীবন গল্প’ দেশের রেডিও ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান। সম্প্রতি মো. গোলাম কিবরিয়া সরকার মুখোমুখি হয়েছেন বাংলানিউজের। উত্তর দিয়েছেন নিজের বর্তমান অবস্থান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা প্রশ্নের... বাংলানিউজ: করোনাকাল কেমন কাটছে? আর. জে. কিবরিয়া: আমাদের করোনাকালের দিনগুলো ওভাবে অনুভব করার সুযোগ নেই। যদিও সতর্ক থাকতে হচ্ছে, তবুও ২৪ ঘণ্টা কাজ লেগেই আছে। অফিস করছি, বসে থাকার ফুসরৎ নেই।
বাংলানিউজ: এখন কোন শো নিয়ে ব্যস্ত আছেন? আর. জে. কিবরিয়া: সিক্রেটস, জীবন গল্প ও তারার রাত। ‘সিক্রেটস’ প্রতি রোববার রাত ১১টা, ‘জীবন গল্প’ বুধবার রাত ১১টা ঢাকা এফএম-এ প্রচার হয়। আর ‘তারার রাত’ শনিবার রাত ১০টায় ঢাকা এফএম ও রেডিও আম্বারে একযোগে প্রচার হয়। বাংলানিউজ: ২০০৬ সালে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর রেডিওতে পার করলেন। পেছনে তাকালে যাত্রাটা কেমন মনে হয়? আর. জে. কিবরিয়া: মনে হয় আমরা একটা সোনালি সময় পার করে এসেছি। পেছনের সময়টা চ্যালেঞ্জিং ছিল, এখনো চ্যালেঞ্জিং, ভবিষ্যতে আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। আমার ক্যারিয়ার মূলত রেডিওতে ১৪ বছর এবং টেলিভিশনে ৯ বছর- এই দুইটা মিলিয়ে। বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণযুগ হারিয়ে যাওয়ার পর মানুষ যখন রেডিও ভুলে যায়; সে জায়গা থেকে নতুন করে টার্ন নেওয়ার সময়টায় আমরা কাজ শুরু করি। তবে এখন রেডিওটা যে আগের অবস্থায় আছে- তা বলা যায় না। তবে শুধু রেডিও না, দেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিরও আগের অবস্থান নিয়ে এক ধরনের তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। এটার কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।বাংলানিউজ: তাহলে কী মানুষ বিনোদনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে? আর. জে. কিবরিয়া: বিনোদন বা কনটেন্টের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি, কমেছে মাধ্যমের প্রতি। যেমন- প্রেক্ষাগৃহে মানুষ সিনেমা দেখবে কিনা সেটা নিয়ে একবার চিন্তা করার সুযোগ আছে।
তবে সিনেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ একদমই কমেনি। এখন হয়তো প্রেক্ষাগৃহে না গিয়ে, নেটফ্লিক্স বা অন্য প্ল্যাটফর্মে দেখছেন। একইভাবে আগে রেডিওতে গান শুনতেন, এখন শুনছেন অ্যাপে। গান মানুষ ঠিকই শুনছে, কিন্তু শোনার মাধ্যম পাল্টে গেছে। তাই রেডিও কিংবা টেলিভিশনটাকেও ডিজিটাল ফরম্যাটে নিয়ে আসতে হবে। বাংলানিউজ: আপনার শো’য়ের সাফল্যের জায়গাটাকে কীভাবে দেখবেন? আর. জে. কিবরিয়া: আমাদের ‘সিক্রেটস’ নামের অনুষ্ঠানটি মূলত ‘যাহা বলিবো সত্য বলিবো’র একটা সংস্করণ।
এই অনুষ্ঠানটি শুরু করার সময় মাথায় ছিল- এতে কিছু মানুষকে আনা হবে; যারা জীবনে বড় ধরনের ভুল করেছেন, অপরাধ করেছেন এবং এর জন্য তারা সাজাও পেয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে সাজা না পেলেও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এই জিনিসটা ফোকাস করা, যাতে করে অন্যরা এই ভুল করা বা অপরাধ করা থেকে দূরে থাকেন। আমি মনে করে এখন পর্যন্ত এটা সফল একটা পদক্ষেপ। ইন্ডাস্ট্রিতে ৭ থেকে ৮ বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এখানে খুনি থেকে শুরু করে ধর্ষক, জেল খাটা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা এসেছেন- স্বেচ্ছায় এসে কান্নাকাটি করে কেন তারা অপরাধ করেছিলেন, তাদের ভুল ছিল কী কী, অপরাধ করে জীবনের পরিণতি কী দাঁড়িয়েছে, নিজেদের জীবনের সব কথা তুলে ধরেছেন। এসব গল্প হাজার হাজার মানুষের জীবনে নীরব প্রভাব ফেলেছে এবং বিপ্লব ঘটিয়েছে। আমি অসংখ্য মেইল পাই, যারা বলেন, ভাইয়া আপনার ওই শোটা আমার জীবন বদলে দিয়েছে, আমি অনেক বড় অপরাধ করা থেকে ফিরে এসেছি।
বাংলানিউজ: রেডিও কঠিন সময় পার করছে। তাহলে ভবিষ্যতে রেডিও জকিদের ক্যারিয়ার কোন দিকে যাবে? আর. জে. কিবরিয়া: দুটা দিক থেকে এটা খুব আতঙ্কের। প্রথমত করোনা পরিস্থিতির পর রেডিওতে বিজ্ঞাপন পাওয়ার বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা। আরেটি হলো- কনটেন্ট। এখনকার সময় কনটেন্ট দিয়ে যদি গ্রাহকদের কোনো রেজাল্ট দেখানো না যায়, তাহলে তারা কেন বিজ্ঞাপন দেবেন? প্রতিটি রেডিওতেই মোটামুটি একই জাতীয় কনটেন্ট দেখা যায়। কোথাও নতুনত্ব নেই, কেউ একটা নতুন আইডিয়া নিয়ে এলে- সেটা সবাই ধুমধাম নিজেদের মতো করে কপি করেন। এছাড়া বিনোদনের মাধ্যম পাল্টে যাচ্ছে।
সবকিছু মিলিয়ে আমি আসলে এই মুহূর্তে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না। বাংলানিউজ: সেক্ষেত্রে ক্যারিয়ারে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? আর. জে. কিবরিয়া: মূলত এই জায়গা থেকে লড়তে হবে। আমরা যারা কাজ করে এই অবস্থায় এসেছি তাদের রেডিও এবং শ্রোতাদের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা আছে। যেহেতু কোনো ফল দেখছি না, লড়তে থাকি দেখা যাক কী হয়। কারণ এই অবস্থাটা হলে তো শুধু আমাদেরই হবে না, পুরো রেডিও অঙ্গনেই প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে যদি চিন্তা করি, যেখানেই মানুষ আছেন, যে মাধ্যমেই থাকুক না কেন-সবাই কিন্তু বিনোদন চায়। আমি প্রায় ১১ বছর ধরে যে ধরনের কনটেন্ট নিয়ে কাজ করছি, তা যদি এক বাক্যে প্রকাশ করি, তাহলে সেটা হচ্ছে ‘মানুষ ও মানুষের গল্প’। সে গল্পগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোস্ট ভাইরাল কনটেন্ট। তার মানে আমার কনটেন্টে কোনো সমস্যা নেই। প্রচারের ফরম্যাট হয়তোবা চেঞ্জ করতে হবে। বাংলানিউজ: শোয়ের মাধ্যমে অনেক সময় আপনি অসহায়দের পাশা দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তারা কতটুকু সহায়তা পান? আর. জে. কিবরিয়া: সর্বশেষ একটা শোয়ের কথা বলি। একটি ছেলে এইচএসসি পাস করার পর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই হাত দুই পা হারিয়েছে।
ঢাকায় সে মাকে নিয়ে ভিক্ষা করে। ভিটামাটি বন্ধক রেখে পরিবার তার চিকিৎসা করিয়েছে। ৭ লাখ টাকা হলে সব ঋণ শোধ করে ছেলেটা আবার পড়াশোনা শুরু করতে পারবে। আমার অনুষ্ঠানে আসার তিন দিনের মাথায় তার অর্থ সংগ্রহ হয়েছে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এটাই একমাত্র উদাহরণ না। আমার ১০ বছরে এমন উদাহরণ শত শত। আমি বহু অসহায়কে লাখ লাখ টাকা মানুষের কাছ থেকে সাহায্য এনে দিয়েছি। কত মানুষের জীবন বদলাতে সাহায্য করেছি সেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তবে এগুলো আমার একদিনে হয়ে যায়নি। গত প্রায় এক দশক ধরে আমার একটা কমিউনিটি তৈরি হয়েছে, মূলত সে বদৌলতে আজকে তা করতে পারছি।
বাংলানিউজ: ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ নামে আপনার একটা অনুষ্ঠান খুব আলোচিত হয়েছে। সেটার অবস্থা কী? আর. জে. কিবরিয়া: এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১২ বছর, ২৪ বছর কিংবা মুক্তিযুদ্ধের আগেও যে মানুষ হারিয়ে গেছে, তারা পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছে। আমি এখন পর্যন্ত ১২টি অনুষ্ঠান করেছি, যার মধ্যে ৮ জনকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। এটা নিয়ে আমার বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। আমার টার্গেট হারিয়ে যাওয়া কমপক্ষে ১০০ জন মানুষকে তাদের পরিবার খুঁজে দেবো।বাংলানিউজ: আপনি জীবনঘনিষ্ঠ শো বেশি করেছেন বা করছেন। এর কারণ কী? আর. জে. কিবরিয়া: এটা একটা মহাসমুদ্র। আমি যে জিনিসটা নিয়ে কাজ করি, সেটা আমার কাছে কখনো পুরাতন হয় না।
যারা দর্শক তাদের কাছেও পুরনো হয় না। প্রায় ১১ বছর ধরে তারা এ ধরনের কনটেন্ট দেখেই যাচ্ছেন দেখেই যাচ্ছেন। কারণ আমার প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রতি পর্ব নতুনত্ব থাকে। একটা পর্ব দেখার পর মানুষ পরবর্তী পর্ব কী গল্প থাকবে সেটা চিন্তাও করতে পারে না। সে জায়গা থেকে আমার মনে হয়ে এটা সেরা একটি কাজ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমি যেই ফরম্যাট নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছি, আমার জ্ঞানত পৃথিবীর কোথাও এটা নিয়ে কাজ হয়নি। একজন মানুষের পুরো জীবনের গল্প নিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠান হতে পারে, এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলানিউজ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই আপনার শোগুলো ভাইরাল হতে দেখা যায়। এখন পর্যন্ত কোন শোটি এ মাধ্যমে বেশি আলোচিত? আর. জে. কিবরিয়া: মানবিক পুলিশ শওকতকে নিয়ে আমি একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। ৫ মাসে সেই অনুষ্ঠানের ভিউ দাঁড়িয়েছে দেড় কোটিতে এবং লাইক পেয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার। ২ লাখ শেয়ার।
রেডিওর ইতিহাসে আর কোনো শো এত রেসপন্স পেয়েছে কিনা, সেটা আমার জানা নেই। বাংলানিউজ: প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আপনার রেডিও জগতে বিচরণ। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষবেন কীভাবে? আর জে কিবরিয়া: প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়টা আমি সেভাবে দেখতে চাই না। সবসময় বলি, আমি অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একটা মানুষ। চাল নেই চুলো নেই এমন একটা পরিবারে আমি বড় হয়েছি। আমার বাবা সরকারের খুব ক্ষুদ্র একজন কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, লোক প্রশাসন বিভাগে ১ম স্থান নিয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি, সেটাই ছিল আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি।
ঢাবিতে পড়াশোনা করতে গিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর কয়েকজন ভোকালের প্রশংসা করলেন। সেখানে বন্ধুরা কাজ করত- আর যুক্ত হয়ে গেলাম। এরপর যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে। আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, নাম-খ্যাতি-অর্থ সবকিছু নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ও সুখি। বাংলাদেশ সময়: জীবনের শেষ সময়টা কোথায় কাটাতে চান? আর জে কিবরিয়া: নিয়তি আমাদের জীবনটাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা তো আগে থেকেই বলতে পারি না। তবে আমার ইচ্ছে আছে জীবন সায়াহ্নে আমি মাটির সঙ্গে সময় কাটাতে চাই। কৃষি কাজে সময় দেবো। আল্লাহ তৌফিক দিলে একটা খামার করবো, জীবনের শেষ সময়ে তা নিয়েই কাটিয়ে দেবো। এছাড়া আমার নিজের স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। আর রেডিও-টেলিভিশনে যতদিন টিকতে পারি ততদিন তো কাজ করবই।