“আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে...ঐ উঁচুতে... আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল” - শার্ল বোদলেয়ার হিন্দুদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে স্বর্গের এর অবস্থান নির্দেশ করা আছে। মহাকাশে নয়, পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরেই একটা স্থান। এখানে যেতে হলে প্রথমে ‘মহা-হিমগিরি’ (হিমালয় পর্বত) অতিক্রম করার পর পার হতে হয় ‘মহা-বালুকাভূমি’ (তিব্বতের গোবী মরুভূমি)। পঞ্চপাণ্ডবরা গোবী মরুভূমি অতিক্রম করেই মেরুপর্বতে (বর্তমানের আলতাই পর্বত) পৌঁছেছিলেন। এই মেরু পর্বতের উপরে অবস্থিত একটি জনপদের নামই ‘স্বর্গ’! পুরাণ থেকে জানা যায়, এই জনপদের অধিবাসীদের পরিচিতি ছিল দেবতা নামে। মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবরা বর্ণিত পথ ধরেই স্বর্গে পৌঁছেছিল, যেখানে যুধিষ্ঠির ভিন্ন দ্রৌপদী সহ অন্যসকল পান্ডবদেরকে কাল গ্রাস করেছিল। মেরু পর্বতকে পৃথিবীর মধ্যবিন্দু হিসাবে গণনা করা হয়। হিন্দু পুরাণে এই পর্বতকেই ‘কৈলাস পর্বত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এই পর্বতের শৃঙ্গ বা শীর্ষদেশের রঙ স্বর্ণাভ। রূপকার্থে যা প্রাচুর্য আর সম্পদকে বিম্বিত করে থাকে। এখানে হিন্দু পুরাণের শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্ম এবং অন্যান্য দেবতারাও বসবাস করতেন। অনেকটা গ্রীক পুরাণের দেবতা জিউসের বাসস্থান অলিম্পাস পর্বতের মত। বৌদ্ধ পুরাণ অনুসারে মেরু পর্বতের চতুর্দিক ঘিরে আছে সাতটি পর্বতমালা। এরাও স্বর্ণাভ বর্ণের। প্রতিটি পর্বতমালা আবার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সমুদ্র দ্বারা। আমি এসব কিছুই জানতাম না। কম্বোডিয়াতে বেশ কয়েক মাস বসবাস করার সূত্রে এ সম্পর্কে আমার মোটামুটি ধারণা হয়েছে। নমপেনের নামকরা মন্দিরসমুহ, এমনকি নমপেন থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দূরে অবস্থিত সিয়ামরিয়েপ নামক স্থানে অবস্থিত পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্য ‘এঙ্কর ওয়াট’ নির্মিত হয়েছিল মেরু পর্বতের আদলে। বলা যেতে পারে পুরো মন্দিরটিই ছিল মেরু পর্বতের ক্ষুদ্র সংস্করণ! মেরু পর্বতের আরেকটা ক্ষুদ্র সংস্করণ লুয়াং প্রেবাং-এও আছে। নাম ‘ফুসি পাহাড়’ (PHOUSI HILL)। মেকং এর তীর ঘেষে এর অবস্থান।
এখান থেকে লুয়াং প্রেবাং এর নান্দনিক সুর্যোদয়- সুর্যাস্ত এবং এবং এই অন্তরীপ শহরের ‘বার্ডস আই ভিউ’ দেখা যায়। পাহাড়টির নামের অর্থ ‘পবিত্র পাহাড়’। সমতল থেকে আনুমানিক ৩০০ ফুট ওপরে। এই পাহাড়চূড়াকে লুয়াং প্রেবাং নগরীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্র বলে ধরা হয়ে থাকে। চূড়ায় আছে সোনালী বর্ণের একটা মন্দির। নাম থাট চমসি (THAT CHOMSI)। আমাদের আজকের গন্তব্য এই পাহাড়ের চূড়া। দুটো পথ আছে এই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্যে। দুটোই ইট-পাথরের সিঁড়ি দিয়ে তৈরি। দুটোই যথেষ্ট প্রাচীন। প্রথম সিঁড়ি পথটি অন্যটার চেয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত ও সোজা। ৩২৮টি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। লাওসের একসময়ের রাজার বাড়ির প্রবেশ ফটকের ঠিক উল্টো দিকে। অন্যটি ফুসি পাহাড়ের অপর দিকে অবস্থিত ‘ফুসি রোড’ রোড থেকে উঠেছে। ৩৫৫টি সিঁড়ি সম্বলিত। চূড়া থেকে নেমে এসেছে সাপের মতন এঁকে বেঁকে। মনে হয় মেঘের রাজ্য থেকে দুটো বিশালকার সাপ এঁকেবেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দুটোই হা করে আছে। দেখতে ‘আরব্য রজনী’র আজদাহা অথবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনের ‘এনাকোন্ডা’দের মত লাগে। প্রথমবার আপনি কিছুটা ভীত এবং অপ্রস্তুতও হয়ে যেতে পারেন। এই পথ দিয়েই মিস্টার জ্যাকসন আর আমি নীচে নেমে এসেছিলাম। পরের পথটা আরো বৈচিত্র্যময়। সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে উঠতে প্রায় একঘন্টা সময়কাল লাগে। মিস্টার জ্যাকসন জানালেন অন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেড় ঘন্টা লাগে। মূলত আমার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা ভাষায় গল্প করার জন্যেই এই আয়োজন।
আমরা বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া আর লাওস নিয়ে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সিঁড়ি ডিঙোতে থাকি। উঠতে উঠতে পিছন ফিরে তাকালেই উত্তরে মেকং নদীর ঘোলা জল দৃশ্যমান হয়। মেকং এর ওপারে সারি সারি পাহাড়। আমাদের জামালপুর জেলার গ্রামের বাড়ির উত্তরের উঠোন থেকে দৃশ্যমান গারো পাহাড় আর মেঘালয় পর্বতমালার অস্পষ্ট নীল রিজলাইনের মতো। আরও দেখা যায় লুয়াং প্রেবাং এর অন্য এক মন্দিরের চূড়া এবং নান্দনিক দৃশ্যাবলী।
মিস্টার জ্যাকসন জানালেন প্রতিদিন বিকেলে হাজার হাজার ভ্রমন পিয়াসী এই পাহাড়ের চুড়ায় আরোহণ করে। চূড়া থেকে সূর্যাস্ত অবলোকন করার জন্যে। তবে আমরা দুজনে এসেছি সকাল বেলায়। জিজ্ঞেস না করলেও সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মিস্টার জ্যাকসন বললেন, “আমার নিকট সকালের দৃশ্যপটই বেশি মোহনীয় আর অনুভব যোগ্য মনে হয়। বিকেলে ভিড় থাকে অনেক বেশি”। সিঁড়িপথটা প্রাচীন সব নাম না জানা বৃক্ষরাজির ভেতর দিয়ে ওপরের দিকে চলে গেছে। পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত। চারপাশের ঘন বন। নীলাকাশ। আকাশের ভেতরে শিমুল তুলোর মত ভাসতে থাকা ‘আশ্চর্য মেঘদল’। নীচে মেকং নদী। বর্ষাকালের যমুনার মত লালচে ঘোলা এর জল। সবুজ বনের ভেতরে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা লুয়াং প্রেবাং এর ঘরবাড়ি। মেকং এর ওপারে সারি সারি পাহাড় অথবা দিগন্ত রেখা।
কুয়াশার মত মেঘ। সবকিছুই আমার চোখে মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দেয়। নিবিড়ভাবে অনুভব করি ভ্রমণের প্রকৃত আনন্দ নিহিত পথ চলার মধ্যেই। সেই পথ স্বর্গে উত্তরণের হোক, অথবা স্বর্গ থেকে পতনেরই হোক! গন্তব্যে পৌঁছা কখনই তেমন জরুরি নয়! মিস্টার জ্যাকসনের কাছে জানলাম পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বোধি লাভের পর নির্বাণের জন্যে ঘুরতে ঘুরতে গৌতম বুদ্ধ এই পাহাড়ের চূড়াতে বসেছিলেন। কিছু সময়ের জন্যে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এবং চলে যাবার সময়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে, এই স্থান একদিন শক্তিমান ও ঐশ্বর্যশালী এক রাজ্যের রাজধানী হবে। আর মাত্র ২০ গজ ফুট উপরে উঠলেই পাহাড়ের চূড়া। সোনালী রঙের একটা মন্দিরের শীর্ষ দৃশ্যমান। মন্দির থেকে একটু দূরে গ্রানাইট পাথরের শিলাখন্ডের ওপরে দুইজন বালক মঙ্ক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অসাধারণ নীল আকাশ। ভেসে বেড়াচ্ছে শ্বেত-শুভ্র মেঘ।
পেঁজা তুলোর মত। মহাদেব সাহার কবিতা মনে পড়ে গেলো – ‘আকুলতা শুভ্রতার জন্যে’ ! ক্লান্ত অথচ আনন্দিতভাবে আ ও এবং মিস্টার জ্যাকসন শেষ কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে ফুসি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের চোখের সামনেই Wat Chomsi নামের সোনালী প্যাগোডা। লুয়াং প্রেবাং এর যে কোন স্থান থেকে এই সোনালী চুড়া দৃশ্যমান। এটা মূলত একটা বৌদ্ধ স্তুপ। পর পর স্থাপিত তিনটা চতুষ্কোণ সাদা রঙের বেইজের উপরে স্থাপিত। উপরের এই অংশটা ইয়ুস্থি নামে পরিচিত। সোনালী রঙের। ক্রমশ সুরু হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে। ইয়ুস্থির ওপরে উলম্বভাবে থরে থরে সাজানো ক্রমে ছোট হয়ে আসা অনেকগুলো চাকতি। এদেরকে বলা হয় ছত্রাবলী। এগুলোও সোনালী রঙের। দূর থেকে দেখতে সূচাগ্র শিখরের মতো লাগে। ফুসি হিলের স্তূপের উচ্চতা ২৪ মিটার। জানা যায়, ১৮০৪ সালে King Anourat কর্তৃক এই স্তূপ নির্মাণ করা হয়েছিলো।
বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ গৌতম বুদ্ধের দেহ, তার বাণী এবং আত্মাকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। ‘মহাপরিনির্বাণ সূত্র’ থেকে জানা যায় যে, মৃত্যুর সময়ে বুদ্ধ তার শিষ্য আনন্দকে তাঁর দেহভষ্মের উপর স্তূপ নির্মাণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কালের বিবর্তনে স্তূপ বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত তিন ধরণের স্তূপ আছে। প্রথমটা শারীরিক স্তূপ। এই শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধ ও তার অনুগামী ও শিষ্যবর্গের শরীরাবশেষ রক্ষিত থাকে। দ্বিতীয়টা পারিভৌগিক স্তূপ। এই শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধ কর্তৃক ব্যবহূত দ্রব্যাদি রক্ষিত থাকে এবং তৃতীয়টি নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ। এই ধরণের স্তুপ বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন স্থান বা ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে নির্মিত হয়ে থাকে।
আমার ধারণা বোধিলাভের পর সিদ্ধার্থের লুয়াং প্রেবাং এ আগমন ও অবস্থানকে নির্দেশ করার জন্যেই এই স্তূপটি নির্মাণ করা হয়েছিল। একটি প্রবেশদ্বার দিয়ে স্তূপটিতে ঢুকতে হয়। প্রবেশদ্বারটি বন্ধ। শুনলাম বিশেষ অনুমতি ছাড়া এর ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। প্যাগোডার পাশে একটা বিহার বা মন্দির। এটার নামই Wat Chomsi। সাদা দেয়ালের। দরজা এবং জানালার ফ্রেমগুলো লাল রঙের। বিহারের ছাদের কোণাগুলো শিঙের মতো বাঁকা ও উর্ধমুখী। এই শিঙগুলোও সোনালী রঙের। ভেতরে একাধিক ভিক্ষু ও বেশ কয়েকজন শিক্ষানবীশ মঙ্ক বসবাস করে। মন্দিরের ভেতরে কয়েকটা বৌদ্ধ মূর্তি আছে। শিশু মঙ্করা এখানেই পূজা করে। তাদের শিক্ষাস্থান এবং বাসস্থানও। সকালে মন্দিরের প্রায় সকল মঙ্করাই লুয়াং প্রেবাং শহরের দিকে গেছে এলম (alms) গ্রহণ করার জন্যে। ফিরে আসেনি এখনও। ফলে মাত্র কয়েকজন মঙ্ক উপস্থিত বিহারে।
সবাই সদ্য শৈশব অতিক্রান্ত করা কিশোর।মিঃ জ্যাকসন আমাকে জানালেন লাওসের অধিকাংশ শিশুরাই বিহারে আসে শিক্ষানবীশ মঙ্ক হিসেবে। এর মূল কারণ দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যাই গরীব কৃষক। সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থ বা সামর্থ তাদের নেই। তবে অনেকে আছে যারা ভিক্ষু হবার জন্যেও এখানে এসে থাকে। যারা ফিরে যায়, তারা সংসার জীবন নির্বাহ করে। গৈরিক রঙের কাপড় পরা দুইজন কিশোর মঙ্ক এসে আমাদেরকে আমন্ত্রণ করে বিহারের ভেতরে নিয়ে গেল। ভীষণ রকমের অতিথি পরায়ণ। চমৎকার ইংরেজি বলছে দুজনেই। জানা গেলো ইংরেজীতে কথা বলতে তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়। যাতে তারা বিদেশী পর্যটকদের নিকটে বুদ্ধের বাণী পৌঁছাতে পারে। ভেতরে বসে আছেন মধ্যবয়সী ভিক্ষু। ইনিই এদের দেখাশুনা ও শিক্ষার দায়িত্ত্বে আছেন। তিনি আমাদেরকে ঘুরে ঘুরে সমস্ত এলাকা দেখালেন। বিহারের সামনে এসে দাঁড়াতেই সামনে নান্দনিক দৃশ্য। সুনীল আকাশের ভেতরে সাদা সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে একপাশ দিয়ে মেকং নদী বয়ে যাচ্ছে। মেকং নদীর ওপাড়ে সারি সারি পাহাড়।
দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিক দিয়ে নামকান নদী। নামকান নদীর ওপরে অস্পষ্ট সাঁকো। নীচে শহরের ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাট। এখান থেকে সবকিছুই নির্জন আর নিশ্চুপ। মনে হয় পৃথিবীর বাইরের কোন স্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এখানে বাতাসের গন্ধও ভিন্নরকমের। প্রধান ভিক্ষু আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানালেন কয়েকদিনের জন্যে তাদের সাথে থেকে যাওয়ার জন্যে। মিঃ জ্যাকসন খুবই উৎসাহী হয়ে উঠলেন। আমাকে বললেন, “চলেন আসাদ ভাই, থেকে যাই। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে আপনার আমার দুজনেরই।” আমিও পুলকিত। তবে সংবরণ করে বললাম, “এবার নয়। পরেরবার এসে আপনার সাথে একমাসের ‘চিল্লা’ দিয়ে যাব।” তিনি হেসে উঠলেন। ‘চিল্লা’ শব্দটার সাথেও তিনি পরিচিত। আমার মনে পড়ে গেলো ১৯৮১ সনের কথা। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে আমার। আমি তখন অবস্থান করছি বাড়িতে। কয়েকদিনেই অস্থির হয়ে উঠেছি। সপ্তম শ্রেণী থেকে এতো দীর্ঘ সময় আমার কখনোই বাড়িতে অবস্থান করা হয়নি। সুতরাং আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ১০ দিনের জন্যে তাবলীগ জামাতে যাবার। আর কিছু হোক না হোক ভ্রমণ তো হবে!
ঢাকার কাকরাইল মসজিদে যখন পৌঁছালাম, তখন বিকেল। মসজিদের পেছনের রমনা পার্কের স্থানে স্থানে অন্ধকার জমে আছে। বৃষ্টিস্নাত বিকেল। কিন্তু সবার চেহারার ভেতরেই একটা অস্থিরতার ছাপ। শুনলাম চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন গতরাতে। তারই সতীর্থদের হাতে। ঢাকায় আর ভাল লাগেনি। পরের দিনই আমরা চলে গিয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেই আমার প্রথম বার তিতাস নদী দেখা। অদ্বৈত মল্লবর্মনের সাথে পরিচয় না ঘটলেও ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটা আমার দেখা হয়ে গেছে ইতিপূর্বেই। ক্যাডেট কলেজের মিলনায়ন্তনে। কিশোর মঙ্কদের একজন আমাকে তার বসবাস কক্ষের ভেতরে নিয়ে গেলো। খুব সাধারণ একটা কক্ষ।
মেঝেতে পাটি বিছানো। ছোট্ট একটা ট্রাঙ্ক আছে তার। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে সে আমাকে বুদ্ধের একটা পোড়ামাটির মূর্তি বের করে আমাকে উপহার দিলো। জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি এখানে আবার আসবে?” আমি বললাম, “অবশ্যই।” “আমার ধারণা তুমি আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না” সে বলল। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার এ ধারণা কেন হল?” সে বলল, “তোমার আগে অনেকেই আমাকে ফিরে আসার কথা বলেছে। কিন্তু কেউই ফিরে আসেনি।“ আমি কিছুটা বিব্রত। তবে তখন আমার যৌবনকাল, যখন ভবিষ্যতকেও মনে হয় হাতের মুঠোয়। খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, “আমি ফিরে আসবো। কয়েক মাস পরে। কম্বোডিয়া থেকে দেশে ফিরে যাবার পূর্বে।” ফিরে যাবার পালা।
মিঃ জ্যাকসন বললেন, “আমার একটু তাড়া আছে। আমি যে পথে এসেছি, সেই পথ দিয়েই ফিরে যাব। আপনি আমার সাথে ফিরে যেতে পারেন। অথবা অন্যপথ দিয়েও নামতে পারেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অন্য পথেই ফিরে যাব বলে তাকে জানালাম। যাবার সময়ে আমাকে তিনি বললেন, বিকেলে এসে King’s Palace দেখে যেতে ভুলবেন না যেনো। লুয়াং প্রেবাং এর প্রধানতম দর্শনীয় স্থান সেটা।” অন্য সিঁড়িপথ দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি এই পথ আরো সুন্দর ও নান্দনিক। রবার্ট ফ্রস্টের দ্বিতীয় পথের মত। সিঁড়ি কিছুদূর নামতেই পাথরের পাহাড়ের গায়ে গুহার মতো একটা মন্দির। নাম Wat Tham Phousi। এর ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা বুদ্ধ মুর্তি। এদের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যবান বুদ্ধ যিনি মুখে হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরো নীচে নামতেই পথের পাশে বুদ্ধের একাধিক রঙিন মূর্তি। বিভিন্ন মূদ্রায় দাঁড়িয়ে আছেন। একটা মূদ্রায় তিনি ভিক্ষার পাত্র হাতে নিয়ে আছেন।
অন্য একটা মুদ্রায় তিনি ধ্যানে নিমগ্ন। বহু মাথার একটা সাপ মাথার পেছন থেকে তাকে পাহারা দিচ্ছে। শিব অথবা শ্রীকৃষ্ণের মতো। আরেক মুদ্রায় বুদ্ধ বৃষ্টিকে ডেকে আনছেন (Rain Mudra)। অবশেষে পাহাড়ের খাঁজে একজায়গায় দেখলাম বুদ্ধ তার শিষ্যদের উপদেশ দিচ্ছেন। পাশেই মহাপরিনির্বানে গেছেন তিনি। শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। ফিরতে ফিরতে আমার মনে হচ্ছিলো এক মহাকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি আমি। নির্বাণ কি এতই সহজ? আমরা ধ্বংসযজ্ঞের ভেতরে বসবাস করা মানুষেরা যা ভেবে থাকি? সত্যই কি মহাকালের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবর্তন আদৌ সম্ভব? শুদ্ধ মানুষ হিসেবে। “আমি যখন কপিলাবস্তু থেকে বেরিয়ে আসি তখন ঘরে সোনার পালঙ্কে স্ত্রী, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছিল সেখানে। শিশুপুত্র।