করোনাভাইরাসের বিস্তারের এই সময়টায় দাঁতের চিকিৎসা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। করোনা ছোঁয়াচে রোগ আর মূলত মুখনিঃসৃত তরল কণার (ড্রপলেট) মাধ্যমে ছড়ায় বলে দন্তচিকিৎসকেরা যেমন ঝুঁকিতে আছেন, তেমনি রোগীরাও। তা ছাড়া ডেন্টাল বিভিন্ন প্রসিডিউরে অ্যারোসল তৈরি হয়, যা পুরো চেম্বার বা ডেন্টাল ক্লিনিককেই দূষিত করে ফেলতে পারে। অন্যান্য রোগীর জন্য যা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সে বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নির্দেশনা দিচ্ছে যে মহামারি চলার সময় জরুরি চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো।
দাঁতের ক্ষেত্রে অসহনীয় দাঁতব্যথা, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, গাল ফোলা যা চোখ বা গলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাওয়া, দুর্ঘটনায় আঘাত অথবা দাঁত পড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো জরুরি অবস্থা। এ জন্য এই সময়েও চিকিৎসকের কাছে অবশ্যই যাওয়া প্রয়োজন। দন্ত চিকিৎসকদের জন্য পরামর্শ কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের গতিপ্রকৃতির নিরিখে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির ‘কোভিড-১৯ প্র্যাকটিস গাইডলাইন’ চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিচের নিয়মনীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। * অপেক্ষাকৃত তরুণ দন্ত চিকিৎসকেরা এ সময় জরুরি সেবা দিতে পারবেন। * টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব হলে সেখানেই সীমিত রাখতে হবে।
* দন্ত চিকিৎসার পরামর্শের সময় অবশ্যই ডেন্টাল সার্জন ও রোগী—দুজনই মাস্ক পরবেন এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্বে থাকবেন। * রোগীর করোনা উপসর্গ থাকলে তাকে দ্রুত নির্ধারিত বুথ বা পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ পরীক্ষা ছাড়া কোনো চিকিৎসা করা যাবে না। * সঠিক সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়া কোনোভাবেই চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। সংশ্লিষ্ট ডেন্টাল সার্জনকে সুরক্ষাসামগ্রীর যথাযথ ব্যবহার, পিপিই পরা এবং খোলা এবং শেষে জীবাণুমুক্ত (ডিসপোজ) করার সঠিক নিয়ম অবশ্যই জানতে হবে। * ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করার নিয়ম জানতে হবে। প্রয়োজনে ডিসপোসেবল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।
* ডেন্টাল সার্জনদের নিজস্ব চশমার বাইরে অবশ্যই ফেস শিল্ড ব্যবহার করতে হবে। * যেসব চিকিৎসায় অ্যারোসল তৈরি হয় যেমন রুট ক্যানাল ওপেনিং, ফিলিংয়ের জন্য ক্যাভিটি প্রিপারেশন—এগুলো এখন করা যাবে না। * চিকিৎসার পর সারফেস ডিসইনফেক্টেন্ট করতে হবে। * চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। * পরিবারের সুরক্ষার জন্য ক্লিনিকের পোশাক (অ্যাপ্রোন, ওটি ড্রেস ইত্যাদি) বাসায় না নেওয়া ভালো। বাসায় গিয়ে ব্যবহৃত পোশাক ডিটারজেন্টের মধ্যে আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং ভালোভাবে গোসল করে জীবাণুমুক্ত হয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সান্নিধ্যে যেতে হবে। দাঁতের যত্ন বাড়িতেই করোনার ঝুঁকি নিয়ে দন্ত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার চেয়ে এ সময় দাঁতের যত্ন নিন আর ছোটখাটো চিকিৎসা বাড়িতেই সারুন। সে জন্য দাঁত ও মুখগহ্বরের যত্নে সাধারণ কিছু পরামর্শ মানলে ঝুঁকি কমবে।
* সঠিক সময় এবং সঠিক পদ্ধতিতে নিয়মিত ব্রাশ করতে হবে। সকালে ও রাতে, খাবারের পর ২ মিনিট ধরে ২ বার। মনে রাখতে হবে, সকালে কিন্তু অবশ্যই নাশতা খাওয়ার পর ব্রাশ করতে হবে। * দাঁত ব্রাশের সঙ্গে ফ্লসিং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাশ করার আগে কিংবা পরে যেকোনো সময় ফ্লসিং করা যেতে পারে, তবে ব্রাশ করার আগেই করা ভালো। একটা কথা মনে রাখবেন, সাধারণ ব্রাশ দিয়ে দাঁতের সব জায়গায় বিশেষ করে দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থান পরিষ্কার করা অনেক সময় সম্ভব হয় না।
* মাউথওয়াশের ব্যবহার মুখগহ্বর ও দাঁতের জন্য উপকারী। সহজভাবে বাড়িতে কুসুম গরম পানিতে লবণ দিয়ে কুলকুচা ও গার্গল করতে পারেন। এ ছাড়া বাজারে নানা ধরনের মাউথওয়াশ পাওয়া যায়, যেগুলো ক্লোরহেক্সিডিন ও পোভিডন আয়োডিনসমৃদ্ধ। চাইলে সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি। খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট পর মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। ন্যূনতম ৩০ সেকেন্ড এবং মাউথওয়াশ ব্যবহারের ৩০ মিনিট পর্যন্ত অন্য খাবার না খাওয়া ভালো। তাতে মাউথওয়াশ ব্যবহারের উপকারিতা বেশি পাবেন।
* নিয়ম মেনে ব্রাশ করার সঙ্গে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে লবণ গরম পানির কুলকুচা করা আর হালকা গরম পানি পান করার অভ্যেস করুন। গরম হারবাল চা, গ্রিন টি, স্যুপ ইত্যাদি পান করতে পারেন। * চিনিযুক্ত এবং আঠালো খাবার খেলে জোরে জোরে কুলি করতে হবে, বিশেষ করে শিশুদের দিকে নজর রাখবেন। এ ধরনের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। * মাড়ি মালিশ করাটাও খুবই উপকারী। তর্জনী দিয়ে সহজে এই কাজ করা যায়। এতে মাড়িতে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং মাড়ি সুস্থ থাকে।
* শিশুদের ক্ষেত্রে দাঁত ওঠার পর থেকেই দাঁত পরিষ্কার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আনুমানিক ৬ মাস বয়স থেকেই কিন্তু এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। পরিষ্কার, ভেজা, নরম কাপড় দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে দিন। সঙ্গে অবশ্যই জিহ্বা পরিষ্কার করবেন। যতবার দুধ খাওয়ানো হবে, মনে রাখতে হবে শেষ ফিডিংটা যাতে পানি হয়। শিশুর দুধে চিনি মেশানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কাপ কিংবা চামচে খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।