আমরা কি তা সইতে পারব?

প্রথম আলো প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২০, ১৬:১৮

যা দেখা হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি রয়ে যায় অদেখা। সেই ‘অদেখা’ এখন ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে চোখের সামনে। এই লেখায় সময়ের এক অদ্ভুত বাস্তবতার কথা জানিয়েছেন কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন। বর্ষার গ্রাম আমার অসম্ভব পছন্দ। বাড়ির ধারে স্কুল, স্কুলের সামনে মাঠ, মাঠের পাশে নদী, নদীতে দুকূল ছাপানো জল। ফুরফুরে হাওয়া, হাওয়ার সঙ্গে মেঘ। আর তার সঙ্গে বৃষ্টিও? আমার শৈশব এমন স্বপ্নালুই। সেই জল থইথই নদীর ধারে বৃষ্টিভেজা মাঠ। মাঠের বুকে আমরা দাপিয়ে বেড়াতাম দিনমান। একদল দুরন্ত কিশোরের ফুটবল-নৃত্যে ছলকে উঠত জল। কিন্তু সেই সব শৈশব আর নেই।

শৈশব হারিয়ে গেলেও সেই মাঠ হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে যায়নি সেই নদী, মেঘ বা বৃষ্টিও। এখনো ভরা বর্ষায় নদী তার দুকূল ছাপিয়ে উছলে ওঠে। ঝুম বৃষ্টি নামে। আকাশ কালো করে ডেকে যায় থমথমে মেঘ। কেবল সেই মাঠ দাপানো কিশোরদের আর দেখা মেলে না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে গাঁয়ের সেই মাঠ খাঁ খাঁ করে। মাঝেমধ্যে গ্রামে গেলে শূন্য সেই মাঠ দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, আবার যদি বন্ধুরা সব নেমে যেতে পারতাম! আসলে গাঁয়ের মানুষ শহরমুখী হয়েছে বেশ আগেই। শৈশবে যাঁদের মাঠে, দোকানে, গৃহস্থবাড়িতে কাজ করেতে দেখেছি, তাঁদের সন্তানদের একটা বড় অংশ এখন কাজ করছে শহরে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামে তাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মূলত গার্মেন্টস কিংবা নির্মাণ শ্রমে। ফলে খানিক সোমত্ত হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের আর দেখা যায় না গাঁয়ে। জীবিকার প্রয়োজন তাঁদের প্রিয়জন থেকে দূরে টেনে নেয়। কিংবা প্রয়োজনই হয়ে ওঠে প্রিয়জন। গতকাল ফেসবুকে একটা ছবি দেখে চমকে উঠলাম।

কোনো এক গ্রামের স্কুলমাঠের ছবি। তুমুল বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা হচ্ছে। মাঠভর্তি নানান বয়সী ছেলেরা। আমার হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। যেন চোখের সামনে চট করে ফিরে এল সেই সোনারঙা শৈশব। কিন্তু তখনো কে জানত পেছনের গল্প? দুই. এই শহরে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ পুষে রেখেছি কার প্রতি? উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে হলো, এর চেয়ে সহজ উত্তর বোধ হয় আর নেই—বাড়িওয়ালা। এই উত্তরের সঙ্গে একমত পোষণ করা লোকেরও অভাব নেই। তা সে কারণে হোক কিংবা অকারণে। আমরা ভাড়াটে, আমাদের দুঃখ, বঞ্চনা দেখার যেন কেউ নেই। যেন আমরা রাজার রাজ্যে খাজনা দেওয়া প্রজা। সেই আমিও পাশের ছোট বাড়িটার বাড়িওয়ালার বিমর্ষ মুখ দেখে চমকে উঠলাম, ‘কী হয়েছে, বাসায় কেউ অসুস্থ?’ তিনি মলিন হাসলেন, ‘নাহ, আল্লাহর রহমতে এখনো ভালোই আছে।’ ‘তাহলে? আপনাকে এত অসুস্থ লাগছে কেন?’ বাড়িওয়ালাসুলভ আভিজাত্যের কারণেই কি না কে জানে, তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘আপনাদের কেমন যাচ্ছে?’ আমিও তাঁর মতো করেই বললাম, ‘এখনো অবধি ভালো। তবে আর কত দিন থাকতে পারব, জানি না...।’ তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও চাপলেন। তারপর আবারও বললেন, ‘আপনাদের কী অবস্থা?’ ‘হ্যাঁ, ভালো।’

‘অন্যদের?’ ‘ভালো।’ ‘অন্য ভাড়াটেদের?’ ‘জি ভালো।’ খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘বাড়িওয়ালার?’ ‘হ্যাঁ, ভালো।’ ‘নিম্ন আয়ের মানুষেরা সব শহর ছেড়ে গাঁয়ে চলে যাচ্ছেন। নতুন ভাড়ার জন্যও কেউ আসে না। সামনে যে কী ভয়াবহ সময়...আমরা তো আর রিলিফের লাইনেও দাঁড়াতে পারব না।’  ভদ্রলোকের প্রশ্ন কেমন অসংলগ্ন লাগছিল। একই কথা যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলছিলেন। যেন সুনির্দিষ্ট কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন, কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। কিছু বলার আগেই পিক আপ ভ্যানটা চোখে পড়ল আমার।

তাঁর বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়ানো। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, লোহার গেটের পাশে স্তূপ করে রাখা মাল-সামানা। গেটের ভেতর থেকে খাট-আলমারির আদল উঁকি দিচ্ছে। আমি বললাম, ‘নতুন ভাড়াটে উঠছে?’ তিনি খানিক চুপ করে থেকে এতক্ষণের চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লেন, ‘নাহ, চলে যাচ্ছে।’ ‘চলে যাচ্ছে? এই সময়ে?’ ‘হু।’ ‘এখন এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনো বাসায় মুভ করাটাও তো রিস্কি!’ ‘নতুন কোনো বাসায় যাচ্ছে না।’ ‘তাহলে?’ ‘গ্রামে।’ ‘এই অবস্থায় এসব নিয়ে গ্রামে কেন যাচ্ছে?’ ‘বেড়াতে তো আর যাচ্ছে না, তারা একদম চলে যাচ্ছে!’ বলে সামান্য থামলেন। তারপর বললেন, ‘না গিয়ে কী করবে? তিন মাস ভাড়া দিতে পারছে না। কাজ নেই। আমার ছোট্ট বাড়ি।

ভাড়া কম বলে নিম্ন আয়ের মানুষেরাই থাকত। গত কয়েক মাসে সব ভাড়াটেই বাসা ছেড়ে চলে গেছে। এই ভাড়াটেই শেষ পর্যন্ত ছিল, আজ সে-ও চলে যাচ্ছে।’ আমি বাড়িওয়ালার দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে। তাঁর মুখ বিষণ্ন। বললেন, ‘আমাদের মতো বাড়িওয়ালাদের সংখ্যাই এই শহরে বেশি। এই বাড়িভাড়া ছাড়া আর কোনো রোজগার নেই। যে টাকা মাস শেষে আসে, বাড়ির মেইনটেন্যান্সেই একটা বড় অংশ যায়। আর যা থাকে, তাতেই কোনোমতে চলে। কিন্তু এখন কী হবে, জানি না।

নিম্ন আয়ের মানুষেরা সব শহর ছেড়ে গাঁয়ে চলে যাচ্ছে। নতুন ভাড়ার জন্যও কেউ আসে না। সামনে যে কী ভয়াবহ সময়...আমরা তো আর রিলিফের লাইনেও দাঁড়াতে পারব না।’ ভাড়াটে লোকটার বয়স অল্প। তাঁর স্ত্রীর কোলে বছর দেড়েকের কন্যাশিশু। বাবার হাত ধরে টুকটুক করে জিনিসপত্র গোছাতে সাহায্য করছে বছর পাঁচেক বয়সের ছেলেটা। তারা গ্রামে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ওপর থেকে কিছু একটা নিয়ে এল লোকটা। একটা পোস্টার বা ক্যালেন্ডার। তিনি হাত ঘুরিয়ে ভাঁজ করছেন বলে দেখতে পেলাম না! গ্রামে যাচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেন সাধ্যের সবটুকু সঞ্চয়! কে জানে, হয়তো তিনিও টের পেয়ে গেছেন, আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাটা ভীষণ অনিশ্চয়তার...   তিন. মৌসুমী জেনারেল স্টোর।

গলির মাথার সবচেয়ে সরগরম মুদি দোকান। ছয়জন কর্মচারীর বসার ফুরসত নেই। এই চিরচেনা দৃশ্যতেই আমরা অভ্যস্ত। সেই ব্যস্ত দোকানে কিছু একটা কিনতে গিয়ে দেখি, একটা মাত্র ছেলে দাঁড়িয়ে। ‘বাকিরা কই?’ জিজ্ঞেস করতেই জানাল, বাকিদের সবাইকে বিদায় করে দিয়েছেন দোকানি! বিক্রিবাটা নেই। এখন খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মালিক। ওই ছেলেগুলো কই গেছে কে জানে? গ্রামে? পরিশিষ্ট: আমি ফেসবুকে দেখা মাঠের ওই ছবিটার দিকে আবারও তাকিয়ে রইলাম। গ্রামে লোক বাড়ছে। শহর ছেড়ে অগোচরে, অভিমানে, নীরবে চলে যাচ্ছে চেনা কিংবা অচেনা অনিকেত আগন্তুক। গ্রামের খাঁ খাঁ শূন্য মাঠ হয়তো সরব হয়ে উঠছে সেই সব মানুষের পদচারণে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us