কেমন হবে করোনা–পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র? কীভাবেই বা সামাল দেবে বাংলাদেশ? বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। করোনায় বাসায় বন্দী দিনমজুর বেকার মানুষের অনাহারের যেমন ঝুঁকি, ঠিক তেমনি করোনাকালীন কাজে গেলে করোনার কবলে পড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি। কীভাবে সামাল দেবে বাংলাদেশ? করোনাভাইরাস ব্যাপক বিস্তারের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে, সেখানে বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের জন্য তার প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করবে, তা বলাই বাহুল্য।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ থেকে নেমে ২ কিংবা ৩ শতাংশ হতে পারে। ২০২১ সালে সেই প্রবৃদ্ধির অবস্থা হবে শোচনীয়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাত।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশ। তার মধ্যে একটা বিরাট অংশজুড়েই রয়েছে পোশাকশিল্প।
কিন্তু করোনা–পরবর্তী সময়ে বিদেশি ক্রেতারা কতটুকু কিনবেন পোশাক, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। কেননা, সাধারণত এ রকম দুর্যোগ ও তার–পরবর্তী সময়ে মানুষ দরকারি জিনিস কেনে। ফ্যাশন সামগ্রী কেনে না। বিজিএমইএ বলছে, বছরের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন মৌসুম চলাকালীন মাঝপথে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন ক্রেতারা। বাংলাদেশ হারাতে যাচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাজার। বাংলাদেশের শিল্পের আরেকটি বিরাট অংশ হলো ভোক্তা ব্যয়, জিডিপিতে যার অবদান ৬৯ শতাংশ। কিন্তু এ বছর মহামারির প্রভাবে যেহেতু টিকে থাকাই দুষ্কর, সেখানে ভোক্তা ব্যয়ের মতো খাতে ব্যয় করা মানুষের জন্য অনেকটাই বিলাসিতা। ফলাফল, এবার এই খাতের জিডিপি নেমে আসবে ১০ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে, পোশাকমালিকদের ক্রয়াদেশ যেমন বাতিল হচ্ছে, তেমনি লকডাউনে কাঁচামালমালিকদের পণ্য নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি দিন আটকে রাখায় বাড়ছে ঋণ। ফলাফল, মালিকদের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা। অন্যদিকে, পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন প্রায় ৪০ লাখের মতো শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই নারী। ক্রমাগত বাজার হারানো, আগের তুলনায় কম উৎপাদন চাহিদা, দেউলিয়া ঠেকাতে মালিকপক্ষ এর শ্রমিক ছাঁটাইকরণ একটি সাধারণ বিষয় হবে, তা বলাই বাহুল্য। এত কিছু সামাল দেওয়ার মতো স্বাবলম্বী কি বাংলাদেশ? তাহলে উপায় কী?করোনা বাংলাদেশের জন্য হতে পারে শাপেবর!বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পের মধ্যে লো বাজেটের পণ্য (টি–শার্ট, গেঞ্জি) রপ্তানি করে সাধারণত। সে ক্ষেত্রে বিলাসী পণ্য কিংবা দামি ব্র্যান্ডের পোশাক রপ্তানি করার দেশগুলোর তুলনায় বাজার হারানোর আশঙ্কা কিছুটা হলেও কম। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া সাধারণত কৃত্রিম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। পোশাক রপ্তানি খাতে সবার প্রথমে চীন, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। আর লো বাজেটের পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। করোনার উৎপত্তিস্থল চীন হওয়ায় অনেক ক্রেতা তাদের অর্ডার সরিয়ে আনতে পারেন বাংলাদেশে। যেটি খানিকটা হলেও বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি বয়ে আনতে পারে। দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতি। কিন্তু শুধু লো বাজেটের পণ্য দিয়ে এই রপ্তানি শিল্পে টিকে থাকার চিন্তা করা শুধু করোনা–পরবর্তী বাংলাদেশ নয়, বরং অদূর ভবিষ্যৎ এর অবস্থার জন্যও ভয়াবহ একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের ওপর জোর দেওয়া একটি সময়োপযোগী এবং কার্যকরী ও সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। কেননা, এগুলা মোটেই কোনো বিলাসী পণ্য নয়, বরং অনেকটাই নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদান। সে ক্ষেত্রে এই দিকে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি সময়ের দাবিমাত্র। একবার এই পণ্যগুলোই ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে বাজার হারানোর আশঙ্কা অনেকটাই কমে আসবে। তবে সে ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে গবেষণার প্রতি। কী এই টেকনিক্যাল টেক্সটাইল?
সুনির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য তৈরি পোশাক যেমন অতিরিক্ত শীতে কিংবা অতিরিক্ত গরমে, খারাপ আবহাওয়ায় এবং বিভিন্ন প্রতিকূল জলবায়ুর অঞ্চলে ব্যবহার করার জন্য পোশাককে টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বলে।বিভিন্ন ক্ষেত্রবিশেষে টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবহারের ভিত্তিতে এদের শ্রণিবদ্ধ করা হয়েছে। তন্মধ্যে মেডিটেক, প্রটেক ও জিওটেক বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্য পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক, এগুলো সবই মেডটেকের উপাদান হিসেবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের এই পোশাকশিল্পের রপ্তানির ব্যাপক প্রসার ও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু মালিকদেরই নয়, বরং দেশের সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।গবেষণাও জরুরি!এ ছাড়া নজর দিতে হবে টেক্সটাইলের গবেষণার ওপর, যাতে সাসটেইনেবল ও রিইউজেবল পণ্য তৈরি করা যায়।