আমরা যা আজ ভাবছি, পশ্চিমা বিশ্ব তা আগামীকাল ভাবছে: ড. বিজন

ডেইলি স্টার প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২০, ১৬:৪১

• জাপান যে পরীক্ষার কথা ভাবছে, আমরা তা করে ফেলেছি।

• অনুমোদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তিন বছরকে তিন দিনে নামিয়ে এনেছে।

• গণস্বাস্থ্যের কিটের পরীক্ষায় সাফল্যের হার ৯০ শতাংশের বেশি।

• আমরা যে কিট উদ্ভাবন করেছি, তা ডা. জাফরুল্লাহ স্যার ছাড়া সম্ভব হতো না।

• করোনার ভ্যাকসিন আসতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে।

• বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ হয়তো আক্রান্ত হয়েছেন।

ড. বিজন কুমার শীল বাংলাদেশের বিজ্ঞানী-গবেষক, পরিচিতি পৃথিবীব্যাপী। ছাগলের রোগপ্রতিরোধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে আলোচনায় এসেছিলেন। তবে, পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ২০০৩ সালে যখন তিনি সিঙ্গাপুরে সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করেন। এখন তিনি আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করে। কিট এখনো অনুমোদন পায়নি, তবে ড. বিজন পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা।

নাটোরের কৃষক পরিবারের সন্তান সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। যোগ দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ক্যামেরার সামনে আসায় ব্যাপক অনীহা। তবুও দ্য ডেইলি স্টারের মুখোমুখি হয়েছিলেন গত ৩০ মে রাত ১০টায়। ড. বিজন কথা বলেছেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে। তার কর্ম-গবেষণা ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বলেছেন অনেক কথা। দ্য ডেইলি স্টারের ফেসবুক পেজে সরাসরি প্রচারিত সেই সাক্ষাৎকার এবার লিখিত আকারে পাঠকের সামনে।

আপনাদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট ‘জি র‍্যাপিড ডট ব্লট’ বর্তমানে কী অবস্থায় আছে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিটের ট্রায়াল চলছে। আশা করছি আগামী সপ্তাহে এই ট্রায়াল শেষ করে তারা রিপোর্ট দেবেন অনুমোদনের জন্য।

গত সপ্তাহে যখন আপনার সঙ্গে কথা হয়, তখনো আপনার আশা ছিল ‘আগামী সপ্তাহে’ ফলাফল পাবেন। সেই সময় পার হয়ে গেছে। এখনো আপনি আশাবাদী। এই আশার সময়টা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?

একটু তো বেশি হচ্ছে। প্রথমে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন রক্ত থেকে শনাক্ত করার জন্য। কিন্তু, ইতোমধ্যে আমরা স্যালাইভা থেকে এটি শনাক্ত করতে পেরেছি। এর মাধ্যমে অতি দ্রুত আমরা শনাক্ত করতে পারছি। দেখা গেছে রোগীর উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই তার স্যালাইভাতে ভাইরাস পাওয়া গেছে। যার কারণে আমরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলকে অনুরোধ করেছি, স্যালাইভা পদ্ধতিতে পরীক্ষার কিট ট্রায়ালের জন্য নিতে। এটা করতে গিয়ে আবার তাদের মিটিং করতে হয়েছে এবং অনুমোদন নিতে হয়েছে। এরপর আমরা তাদের কিট দিয়েছি এবং স্যালাইভা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় কন্টেইনার, যেটা তাদের কাছে ছিল না, সরবরাহ করেছি। এ কারণে হয়তো একটু বেশি সময় লাগছে। তবে, তা সত্ত্বেও বলবো, সময় বেশি লেগে যাচ্ছে।

আপনারা হয়তো জানেন বিশ্বে দুইটি দেশে অ্যান্টিজেন কিট অনুমোদন পেয়েছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রে এবং অপরটি জাপানে। জাপানের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তারা ভবিষ্যতে স্যালাইভার বিষয়ে ভাববেন। কিন্তু, তার আগেই আমরা স্যালাইভা পরীক্ষা করে ফেললাম। এর মাধ্যমে বেশ ভালো ফলাফল আমরা পেয়েছি।

আপনারা জানেন যে আমাদের কিট দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর করোনা আমি শনাক্ত করেছি। আমাদের কিট দিয়ে গত ২৬ মে আমরা পরীক্ষা করি। ২৭ মে তিনি পিসিআর পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আপনারা অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা পৃথিবীতে প্রথম দিয়েছিলেন। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র পরে ঘোষণা দিলেও আগে বাজারে নিয়ে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কিটের অনুমোদন দিয়েছে। জাপানের আগে আপনারা স্যালাইভা পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন। আগের মতো এই ক্ষেত্রে আবারও কি আপনারা পিছিয়ে পড়বেন?

সেই সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমরা এর জন্য পেটেন্ট ফাইল করেছি। যদি অন্য কেউ এটা করতে চায়, তাহলে তার জন্য আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।

কিন্তু, আপনাদের কিট নিয়ে তো বহু সমালোচনা। দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের অনেকে বলেন, এই ধরনের কিট দিয়ে পরীক্ষা করলে সঠিক ফল পাওয়া যায় না।

নভেল করোনাভাইরাস আমার কাছে নতুন না। কারণ, ২০০৩ সালে আমি সার্স করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করেছি। এটা সার্সেরই খুব ঘনিষ্ঠ ভ্রাতা। এটা অনেকটা সার্সের মতোই। যারা এসব বলছেন, ফলাফল ঠিক মতো আসে না বা সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না, তারা সবাই অনেক অভিজ্ঞ, আমি তাদের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি নই। আমি যা বলছি, যা করছি, তা নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে সার্স শনাক্ত করতে আমি চারটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছিলাম। যার প্রথম এবং দ্বিতীয়টি বর্তমানে বাংলাদেশে করা যাচ্ছে না। কারণ, সেই ক্যাটাগরির ল্যাবরেটরি আমাদের নেই।

এরপর আছে পিসিআর পদ্ধতি, সেটা আমরা সেই সময় (২০০৩ সালে) সিঙ্গাপুরে ডিজাইন করেছিলাম। সর্বশেষ পদ্ধতি ছিল ডট ব্লট। ডট ব্লট পদ্ধতিটা সবচেয়ে দ্রুত শনাক্ত করার পদ্ধতি। পিসিআরে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে এবং সেল কালচারে তারও বেশি সময় লাগে। ডট ব্লটে সময় লাগে ১৫ মিনিট। যেটাতে এখন সময় লাগছে তিন থেকে পাঁচ মিনিট। আমরা গবেষণা-উদ্ভাবন-পরীক্ষার ভিত্তিতে বলছি যে, সঠিক ফলাফল পেয়েছি। যারা বলছেন (কিটে সঠিক ফল পাওয়া যায় না), তারা কিসের ভিত্তিতে বলছেন আমরা জানি না।

এটা সঠিক ফল দেয় না, এই প্রচারণার কারণ কী?

যারা বলছেন তারা কিছু জানেন না, তা আমি বলব না। তারাও জানেন। কিন্তু, এই বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বেশি রয়েছে। অ্যান্টিবডি পরীক্ষা দরকার আছে, অ্যান্টিজেন পরীক্ষাও দরকার আছে। গত ২০ বছরে মলিকুলার টেকনোলজির বিশাল সম্প্রসারণ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময় জানা গেছে যে, পিসিআর পরীক্ষার ফলাফলে ভুল আসছে। সবচেয়ে বড় কথা পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ একটি বড় ব্যাপার। যদি আপনি সঠিক জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ না করেন বা করতে না পারেন, তাহলে পরীক্ষায় সঠিক ফল পাবেন না। দক্ষ টেকনিশিয়ান দরকার, সেই সঙ্গে এটি সংরক্ষণও জরুরি। এগুলোর অভাবে দেখা যায় পিসিআর পরীক্ষায় সাধারণত ৩০ শতাংশ ভুল ফলাফল আসতে পারে। আর পিসিআর মেশিনের দামও অনেক বেশি। সেই সব চিন্তা থেকেই এই র‌্যাপিড ব্লট কিট তৈরি করা। তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এটা দিয়ে আপনি পরীক্ষার ফল জানতে পারবেন। সমালোচনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তা গঠনমূলক হলে আরও বেশি শ্রদ্ধা করব।

যখনই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, শুনি যে আপনি ল্যাবে। ল্যাবে এখন ব্যস্ত কী নিয়ে?

লকডাউনের কারণে আমাদের প্রত্যেকটি রিএজেন্ট আমদানি করতে হয়েছে। সেগুলোও এসেছে অনেকগুলো দেশ ঘুরে। সময় বেশি লাগার কারণে সেগুলো নিয়েও কিছু চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে। কিন্তু, আমরা পরাজিত হইনি। সেই সঙ্গে যেহেতু অনেক সমালোচনা মাথায় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তাই আমরা এটিকে আরও রিফাইন করার কাজ করছি। আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এখন যে ল্যাবে আমরা কাজ করছি এটি তৈরি করেছিলাম মাত্র সাত দিনের মধ্যে। আমরা যা আজ ভাবছি, পশ্চিমা বিশ্ব তা আগামীকাল ভাবছে। এজন্যে আমাদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে, যাতে কোনো ভুল না হয়।

সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের ল্যাবে কাজ করে এসেছেন আপনি। সেখান থেকে ফিরে বাংলাদেশে এসে গরিবের জন্যে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

আমাদের টিমে গবেষক যারা আছেন, তারা সবাই খুবই মেধাবী। সিঙ্গাপুরে কাজের সময় যখন যেটা চাইতাম খুব দ্রুতই তা চলে আসত। তখন কোনো লকডাউন ছিল না। সেখানে অ্যান্টিজেন আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। কিন্তু, এখন এই অ্যান্টিজেন পেতে আমাদের খুব বেগ পেতে হয়েছে। আমাদের অনেক কিছুতেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোনো কিছুই আমাদের দেশে তৈরি হয় না, সবই বাইরে থেকে আনতে হয়েছে। অনেকেরই সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের সাহায্য করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের সাহায্য করেছে। কাস্টমস আমাদের সাহায্য করেছে। সবার সহযোগিতা নিয়েই আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। সামনের বাধাও আশা করি অতিক্রম করতে পারব।

সিঙ্গাপুরে সার্স ভাইরাসের কিট উদ্ভাবনের পর তার অনুমোদন পেতে আপনাদের কতদিন লেগেছিল?

তখন ছিল সার্স ভাইরাস সংক্রমণের জরুরি পর্যায়। যে কারণে আমাদের কিটের অনুমোদনের জন্যে বাড়তি কোনো সময় লাগেনি। আমি সিঙ্গাপুর সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলাম। সেটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেখানে কাজ করে আমরা যে কিট তৈরি করেছি, সেটাই সরকার অনুমোদিত বলে ধরা হয়েছে। সরাসরি শনাক্তের কাজ শুরু হয়েছে সেই কিট দিয়ে।

সার্সের তুলনায় করোনাভাইরাস অনেক বেশি জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে সারাবিশ্বে। এমন সময়ে কিট অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো কেমন সময় নিচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ’র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অনুমোদন পেতে আপনাকে কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা লিখে, কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে তারপর অনুমোদন পেতে হয়। সেই এফডিএ অ্যান্টিজেন কিট তিন দিনের মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কেমন সময় নিচ্ছে। তিন বছরকে তিন দিনে নামিয়ে এনেছে।

জানা যায় বিশ্বব্যাপী পিসিআর পরীক্ষায় কমবেশি ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল আসে। আপনাদের কিটে ভুল ফলাফল আসার সম্ভাবনা কতটা?

কোনো পরীক্ষায়ই শতভাগ সঠিক ফল পাওয়া সম্ভব না। কেউ যদি এমনটা বলে, তাহলে ভুল বলবে। অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কারণে আমাদের পরীক্ষায় ফাঁকফোকর কম। আমাদের কিটের পরীক্ষার সাফল্যের হার ৯০ শতাংশের বেশি হবে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us