মুহাম্মদ বিন কাসিম ট্র্যাজেডি

নয়া দিগন্ত হামিদ মীর প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২০, ০৫:৫৩

তার কণ্ঠস্বরে কয়েক শ’ বছরের বেদনা জমে ছিল। তার এক একটি শব্দ বেদনায় নিমজ্জিত ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি নিজের নয়, বরং আমার বেদনা ব্যক্ত করছিলেন, আর আমি কানে ফোন ধরে নীরবে ওই মুরুব্বির কথা শুনছিলাম, যিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের শিক্ষক ছিলেন। মুরুব্বি বলেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরকে পরাজিত করেছেন এবং আপনাদের হিরো হয়ে গেছেন। কিন্তু ওই হিরোর মৃত্যু কোনো হিন্দুর হাতে হয়নি, বরং মুসলমানের হাতে হয়েছে। আর আজো মুসলমানদের মূল ভয় অমুসলিমদের চেয়ে মুসলমানদের নিয়েই বেশি। এ বাক্য বলার পর মুরুব্বি চুপ হয়ে গেলেন। আমিও চুপ ছিলাম। তার এই বাক্যের নেপথ্যে বিদ্যমান কাহিনী অনুধাবনের চেষ্টা করছিলাম। এ মুরুব্বি ৬ মে ২০২০ অধিকৃত কাশ্মিরের পুলওয়ামা অঞ্চলে শহীদ হওয়া হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার রিয়াজ নায়কোর গুরু ছিলেন। রিয়াজ নায়কোর জিহাদি নাম মুহাম্মদ বিন কাসেম। আর এই মুহাম্মদ বিন কাসেমের শিক্ষক আমাকে এ কথাই বলছিলেন যে, তার ছাত্রের মৃত্যু কোনো রাজা দাহিরের কারণে হয়নি, বরং ওই সব মুসলমানের কারণে হয়েছে, যারা ইসলামী খেলাফত কায়েম করার দাবিদার, অথচ তারা বাস্তবে ভারতের গোয়েন্দা দফতরগুলোর হাতের খেলনা।

অতঃপর মুরুব্বি আবার বলা শুরু করলেন, হিজবুল মুজাহিদিন রিয়াজ নায়কোর স্থানে সাইফুল্লাহ মীরকে নতুন কমান্ডার নিযুক্ত করে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এজেন্টরা সাইফুল্লাহ মীরকে মীর জাফর আখ্যায়িত করতে শুরু করে দিয়েছে। কেননা সাইফুল্লাহ মীরও রিয়াজ নায়কোর মতো ইসলামী খেলাফতের সমর্থন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। কেননা খেলাফতের স্লোগানদাতারা স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষের লোকদের এক করার পরিবর্তে তাদের পরস্পর লড়াইয়ের ইস্যু সৃষ্টি করেছে। এ মুরুব্বি বলছিলেন, তিনি পুলওয়ামার এক স্কুলে রিয়াজ নায়কোকে গণিত পড়িয়েছেন। এরপর রিয়াজ নায়কোও গণিতের শিক্ষক হন। তিনি গণিতে পিএইচডি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন রিয়াজ নায়কোকে মুহাম্মদ বিন কাসিম বানিয়ে দেয়। দুই বছর আগে এই মুরুব্বির পৌত্রও রিয়াজ নায়কোর সাথে গিয়ে যোগ দেন। এরপর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই মুরুব্বির পুরো পরিবারকে এতটাই অতিষ্ঠ করে ছাড়ে যে, মুরুব্বি তার ঘনিষ্ঠজন খাজা জাফর নায়েকের সহযোগিতায় কাশ্মির ত্যাগে বাধ্য হন।

এই মুরুব্বির সাথে আমার পরিচয় খাজা জাফর নায়েকের মাধ্যমে হয়েছিল। ওই মুরুব্বির পরিবারের কিছু সদস্য এখনো পুলওয়ামাতে রয়ে গেছেন। সুতরাং আমি তার নাম উল্লেখ করছি না। তিনি চাচ্ছিলেন, আমি যেন তার পয়গাম নওজোয়ানদের কাছে পৌঁছে দিই যে, ইসলামী খেলাফতের নামে সিরিয়া থেকে আফগানিস্তান বোমা হামলায় নিষ্পাপ নারী-শিশুকে হত্যা করা এবং জালেমদের কর্তৃক সব মুজাহিদের বদনাম করা ইসলামের খেদমত নয়; বরং ইসলামের অনুসারীদের পিঠে খঞ্জর ঢুকিয়ে দেয়ার নামান্তর। মুসলিম যুবকরা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নিজেদের হিরো অবশ্যই বানাবে, তবে মনে রাখতে হবে, মুহাম্মদ বিন কাসিম শুধু একবার রাজা দাহিরকে পরাজিত করেননি। তিনি বারবার কোনো না কোনো রাজা দাহিরকে পরাজিত করেছেন এবং তিনি বেশির ভাগ সময় কোনো সুলায়মান বিন আবদুল মালিকের নির্দেশে কোনো ইয়াজিদ বিন আবু কাবশার হাতে গ্রেফতার হয়েছেন এবং মারা গেছেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের ব্যাপারে কিছু ঐতিহাসিক ভুল নিরসন হওয়া জরুরি। তিনি যখন সিন্ধু আক্রমণ করেন, তখন তার বয়স ১৬ বা ১৮ বছর নয়, বরং তার বয়স ছিল ২৮ বছর।

উপমহাদেশে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য আসেননি। তার এখানে আসার ৭৮ বছর আগে মুসলমান শুধু উপমহাদেশেই আসেননি, বরং তারা কয়েকটি এলাকা বিজয়ও করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমকে খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরকে শাস্তি দেয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কেননা সে কিছু বিদ্রোহী মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছিল। ওই সময় সেরেনদীপের (শ্রীলঙ্কা) মুসলমানদের একটি কাফেলা সামুদ্রিক নৌযানে ইরাক যাচ্ছিলেন। ওই কাফেলাকে সিন্ধুর দেবল বন্দরের কাছে লুট করা হয়। এক আরব নারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে সাহায্যের আহ্বান করলে তিনি খলিফার কাছে হামলার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু অনুমতি পাওয়া গেল না। বেশ কিছু দিন পর তিনি সামুদ্রিক দস্যুদের বিরুদ্ধে এক অভিযান শুরু করেন। এটা সফল হয় না। ওই সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ফার্স ও শিরাজের গভর্নর বানানো হয়। সেখানে তিনি কুর্দিদের বিদ্রোহ দমন করেন। এরপর তিনি সিন্ধু আক্রমণের অনুমতি লাভ করেন। সিন্ধুতে রাজা দাহিরকে পরাজিত করার পর অনেক স্থানীয় হিন্দু মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীতে যুক্ত হন।

যখন তিনি মুলতান বিজয় করেন তখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মারা গেছেন। কিছু দিন পর ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকও ইন্তেকাল করেন। এরপর যখন সুলায়মান বিন আবদুল মালিক খলিফা হন, কিছু বর্ণনা মোতাবেক রাজা দাহিরের এক কন্যা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে; যার পরিপ্রেক্ষিতে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে গ্রেফতার করে ইরাকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু জুলুম-নির্যাতনের ফলে তিনি পথিমধ্যেই ইন্তেকাল করেন। খলিফার সামনে যখন তার লাশ পৌঁছে, তখন রাজা দাহিরের কন্যা বলে, সে মিথ্যা বলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতি তার বাবার পরাজয়ের বদলা নিয়েছে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাহিনী সমাপ্ত করার পর মুরুব্বি আমাকে বললেন, সুলায়মান বিন আবদুল মালিক, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে যা কিছু করেছেন, ঠিক তাই করেছেন ভারতের বাদশাহ আকবর কাশ্মিরের শাসক ইউসুফ শাহ চকের সাথে। তাকে ধোঁকা দিয়ে গ্রেফতার করে কাশ্মির দখল করেন এবং পাঞ্জাবে হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ:-এর অনুসারী দুলাভাট্টিকে ফাঁসি দেন। কাশ্মিরিদের কখনো লুট করেছেন আকবর, কখনো আহমদ শাহ আবদালি, কখনো রঞ্জিত সিং। কাশ্মিরিদের কাছে আকবর ও রঞ্জিত সিংয়ের মাঝে কোনো তফাত নেই। এ জন্য কাশ্মিরের নওজোয়ানরা মুহাম্মদ বিন কাসিম ও সালাউদ্দিন আইউবিকে তাদের হিরো মনে করে। কিন্তু সুলায়মান বিন আবদুল মালিকের মতো খেলাফত কায়েম করার আগ্রহী ব্যক্তিরা কাশ্মিরি যুবকদের পরস্পরে লড়াই বাধাতে চায়। মুরুব্বি বলেন, আমার কোনো সন্দেহ নেই, রিয়াজ নায়কোর খবর আদান-প্রদান করেছে আইএস, যা গত বছর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৈরি করেছে। এখন আইএসের লোকেরা সাইফুল্লাহ মীরকে মীর জাফর অভিহিত করছে। এ দুর্ভাগাদের জানা নেই যে, কাশ্মিরের মীরদের সাথে মীর জাফরের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে নজফ থেকে আগমনকারী সাইয়েদ ছিল। তার নাম সাইয়েদ জাফর আলী খান নাজাফি। মীর তো তার পদবি ছিল। কেননা সে সিপাহিদের মীর অর্থাৎ আর্মি চিফ ছিল।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us