দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা মৃগেল কালিবাউশ) মা মাছ। প্রায় তিন শতাধিক নৌকার মাধ্যমে ৬শ ১৫ জন মানুষ জাল দিয়ে ২৫ হাজার ৫শ ৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফানের কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে বজ্রসহ ভারী বর্ষণের পর হালদায় আসা মা মাছগুলো ডিম ছাড়তে শুরু করে। হালদা বিশেষঞ্জরা জানান, বিগত বারো বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিম সংগ্রহ করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার রেকর্ড সংখ্যাক ডিম ছেড়েছে হালদায়। এর কারণ হিসেবে নদী দূষণকারী দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া, লকডাউনের কারণে নদী সংলগ্ন বিভিন্ন কারখানার দূষণ না থাকা, ড্রেজার চলাচল বন্ধ ও মা মাছের মৃত্যু তুলনামূলক কম হওয়া। সর্বোপরি উপজেলা প্রশাসনের নানা উদ্যোগ ডিম বেশি দেওয়ার অন্যতম কারণ। সকাল ৭টা থেকে একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করে ২৮০টি নৌকা।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে নদীতে জেলেদের জালে বাড়তে থাকে ডিমের পরিমাণ। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হালদা নদীতে মা মাছের নমুনা ডিম দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। হালদা নদীর কাগতিয়ার মুখ থেকে গড়দুয়ারা নয়াহাট পর্যন্ত বিভিন্ন নৌকার ডিম সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন যে তারা প্রতি জালে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম পর্যন্ত নমুনা ডিম পেয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ডিম সংগ্রহের পরিমাণ আশানুরুপ হয়েছে। প্রতিটি জালেই কমপক্ষে এক কেজি করে ডিম পাচ্ছে। ডিম সংগ্রহ করছেন অন্তত ৩০০ জন। ডিমগুলোও হেলদি। এ বছর লকডাউনের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রামের সব ধরনের কলকারখানা বন্ধ হালদায় দূষণ কম হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসন অভিযানসহ সচেতনতামূলক নানা কাজের সুফল মিলেছে। ফলে এবার ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ডিম সংগ্রহের রেকর্ড হয়েছে।’
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘হালদায় এবার সন্তোষজনক ডিম ছেড়েছে মা মাছ। ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ছে। কী পরিমাণ ডিম হালদা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তা তাৎক্ষণিক বলা যাচ্ছে না।’ ডিম সংগ্রহ শেষে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মা মাছের ডিম সংগ্রহের পর রেণু ফোটানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে হাটহাজারী উপজেলার শাহমাদারি, গড়দুয়ারা ও রাউজান অংশের মোবারকখীল ও পশ্চিম গহিরায় মোট ৫টি সরকারি হ্যাচারি ও ১৬৭টি কুয়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয়রা আরও শতাধিক কুয়া তৈরি করেছে। স্থানীয় প্রশাসন ডিম সংগ্রহ ও রেণু ফোটানো, বিক্রিসহ সব বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। গবেষকরা জানিয়েছে, হালদায় বর্তমানে ৫০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। হালদা নদীর কিছু ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যই এই নদীকে মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী করে তুলেছে। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এই নদীর অনেকগুলো বাঁক যেগুলোকে ‘অক্সবো’ বাঁক বলে। এই বাঁকগুলোতে স্রোতের ফলে প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয় যা গভীর স্থানের সৃষ্টি করে। স্থানীয় ভাষায় গভীর স্থানগুলোকে ‘কুম’ বা ‘কুয়া’ বলা হয়। উজান থেকে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয় ফলে পানি ফেনিল ও ঘোলাটে হয়ে যায়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয়।
তাছাড়া এক গবেষণায় দেখা গেছে, হালদা নদীর গভীরতা ও গঠন এমন যে কিছু কিছু স্থানে পানির চতুর্মুখি বা ত্রিমুখি ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়, যেগুলোকে ভর্টেক্স জোন বলা হয়। এই ঘূর্ণনের ফলে হালদা নদীতে বহুমুখি স্রোতের সৃষ্টি হয় যা মাছকে ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এরকম বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোনো নদীতে পাওয়া যায় না। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণা বা ছড়া এবং প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব।