বিশ্বজীবনের কঠিন দুঃসময়ে পৃথিবীর সকল বাঙালিকে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে চলে গেলেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ব্যক্তি প্রতিভার মূল্যায়নে একেকজন মনীষীর ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড ব্যবহার করি, কিন্তু একটা জাতির ইতিহাসের সমগ্রতার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি প্রতিভার বিচার তা থেকে স্বতন্ত্র হতে বাধ্য।
আনিসুজ্জামান বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সৃষ্টিশীলতার দীর্ঘ ইতিহাসের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও তার পরবর্তী বাঙালি জীবনের প্রতিটি রক্তাক্ত ও আলোকোজ্জ্বল ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা কেবল পরিস্থিতিগত ছিলো না; ছিলো অস্তিত্বগত ও সমগ্র জীবনশৃঙ্খলার সক্রিয়তায় বিশিষ্ট।দেশভাগের রক্তাক্ত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পারিবারিকভাবেই তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানবাদী রাজনীতির অন্তর্নিহিত ঘোর অন্ধকার ও অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বর্ণিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মমূল্যায়ন ও রাজনৈতিক বিবেচনাবোধের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে তার আশ্চর্য সঙ্গতি লক্ষ করি।
আনিসুজ্জামানের নিজের ব্যক্তিকথা ও বিভিন্ন রচনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে কারণে লক্ষ্য করি, ১৯৪৮ সালে সূচিত বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি জীবনের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তার সংশ্লিষ্টতা কর্ম ও সাধনার অভিন্ন ধারায় মিলে গেছে। ব্যক্তির দর্শন একদিনে সৃষ্টি হয় না; কর্ম, অভিজ্ঞতা ও সাধনার মধ্য দিয়ে তার পরিপূর্ণতা। খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যক্তি চেতনায় কালের প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান হলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি কেবল কালচেতনাকে নয়, ভাবীকালের সম্ভাবনার দর্শনকেও নিজ সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে ধারণ ও লালন করেছেন।