করোনা মহামারি নিয়ে প্রাথমিক আতঙ্কটা মনে হয় একটু কমেছে। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখছি পৃথিবীর কোন না কোন দেশ তাদের ঘরবন্দি মানুষদের একটু একটু করে বাইরে আসতে দিচ্ছে। জ্বর হয়েছে বলে মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসার মত ঘটনা পত্রিকায় আসছে না। কিছুদিন থেকে আমিও লেখাপড়া নিয়ে টেলিফোন পেতে শুরু করেছি। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করা খুবই সহজ হয়ে গেছে শুধু একটা শার্ট পরতে হয়, শেভ না করলেও কেউ কিছু মনে করে না। তবে কিছু কিছু বাক্যে আমি এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি—কেউ যখন বলে, “স্যার আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে!” আমি তখন প্রবলভাবে আপত্তি করে বলি, “না এটা মোটেও দেখা না, সামনাসামনি না দেখা পর্যন্ত আমি সেটাকে মোটেও দেখা বলতে রাজি না।” ছোট একটা স্ক্রিনে আধা যান্ত্রিক গলার স্বর শুনে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না। সারা পৃথিবীর মানুষের মতো আমিও বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করছি কখন আমরা আবার আগের জীবন ফিরে পাব, একটা শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারব এবং সেজন্য বাসায় এসে টানা বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে না! আমি ধীরে ধীরে খবর পেতে শুরু করেছি যে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে ঘরে ঘরে বাবা-মায়েদের ভেতর এক ধরনের দুর্ভাবনা জমা হতে শুরু করেছে। যদি এই বিষয়টা বিচ্ছিন্নভাবে দুই এক জায়গায় হতো তাহলে সেই এলাকার বাবা-মায়েরা দুর্ভাবনা করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু এই করোনা বিপর্যয় শুধু দু-এক জায়গায় নয়, এমনকি শুধু সারা দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে তাই আমি মনে করি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মায়েদের আলাদাভাবে দুর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। এই করোনার কালে বাবা-মায়েরা যদি লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করেন, আমার মনে হয় তাহলে তাদের দুর্ভাবনাটা আরও কমে যাবে। কোনো কিছু জানা বা শেখা লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য না। লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন ছেলে বা মেয়ের ভেতরে জানা কিংবা শেখার ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া। যার ভেতরে জানা বা শেখার ক্ষমতা আছে সে যেকোনো কিছু নিজে নিজে জেনে নিতে পারবে বা শিখে নিতে পারবে। মনে আছে আমি যখন সেই নব্বইয়ের দশকে দেশে ফিরে এসে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন দেশে কম্পিউটার এত সহজলভ্য ছিল না। যখন নুতন ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ভর্তি হতো তখন পুরো ক্লাসে অল্প কয়েকজনকে পাওয়া যেত যারা আগে কম্পিউটার ব্যবহার করে এসেছে। কম্পিউটার ল্যাবে তাদের কম্পিউটার ব্যবহার করা দেখে অন্যরা একইসাথে হতাশা এবং হীনমন্যতায় ভুগতো। আমি তখন ছেলেমেয়েদের বলতাম, “যাদের দেখে তোমরা এত নার্ভাস হয়ে আছো তাদের সাথে তোমাদের পার্থক্য মাত্র এক সপ্তাহ।”