অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দিনে সরকারি, রাতে বেসরকারি

মানবজমিন প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, ভিসিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক ও একাডেমিক লিডার। কিন্তু কোনো কোনো ভিসি ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী, তা ভুলে গেছেন। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় চ্যান্সেলর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতাদের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করেন। দীর্ঘ বক্তব্যে বরাবরের মতো এবারও জোরালোভাবে ইভেনিং কোর্সের বিরোধীতা করেন। বলেন, কিছু শিক্ষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সাইটেশন পাঠ করেন। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমিক রে রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তাকাকি কাজিতা সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এসময় প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীনসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক পরিষদের সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। এবারের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ৭৯জন কৃতী শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীকে ৯৮টি স্বর্ণপদক, ৫৭জনকে পিএইচডি, ৬জনকে ডিবিএ এবং ১৪জনকে এম ফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সমাবর্তনে ২০ হাজার ৭৯৬জন গ্র্যাজুয়েটকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনগণ অনুষদভুক্ত বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েটদের নাম উপস্থাপন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো: এনামউজ্জামান সমাবর্তন অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু জ্ঞান অর্জন করা নয়। বরং অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোই হচ্ছে আসল কাজ। গবেষণা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাজ। গবেষণার মান নিয়েও এখন নানা কথা ওঠে। কোনটি পদন্নোতির জন্য গবেষণা, কোনটি মৌলিক গবেষণা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক বিভাগই এখন অন্যান্য পদের শিক্ষকের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। অনেক শিক্ষকই প্রশাসনিক পদ-পদবি পেয়ে নিজে যে একজন শিক্ষক, সেই পরিচয় ভুলে যান। তিনি বলেন, সমপ্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, লাশ হয়ে বা বহিষ্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। কর্তৃপক্ষ সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে অপ্রত্যাশিত ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হতো। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। আমি আশা করি, কর্তৃপক্ষ এরপর থেকে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেবে। এসময় দীর্ঘদিন পর হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন দেয়ায় প্রেসিডেন্ট ঢাবি ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে নির্বাচনের সময় ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ভবিষ্যতে এসব ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তিনি আরো সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে তিনি ডাকসু নেতাদের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করেন। বলেন, ডাকসু নির্বাচন হলো। আমি আশা করছি শিক্ষার্থীবান্ধব কথাগুলো ডাকসু বলবে। কিন্তু তারা এ ব্যপারে কোন কথা বলেন না। আবার তাদের ব্যাপারে এমনসব কথা শুনি যেগুলি আমার ভালো লাগে না। এর বেশি কিছু বলে আমি কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চাই না। তবে তাদের কর্মকাণ্ড আমার ভালো লাগে না। যা সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করে সেটা তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইভেনিং কোর্সের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, আপনাদের কাছে আমার বলতে সংকোচ লাগে তারপর আমি না বলে পারছি না। আপনাদের যে ইভেনিং কোর্স আমার ভালো লাগে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যার পরে আর কোন পরিবেশ থাকে না। প্রায় ১৫-২০ হাজার ছেলে মেয়ে অতিরিক্ত বিরাজ করে। ইভেনিং কার্যক্রমের অনিয়মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি শুনেছি, তাদের একটা বিষয় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস। এতে তাদের ২২টা কোর্স। প্রতি কোর্সে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। এতে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকার ওপরে হয়। এর অর্ধেক শিক্ষকরা পান, আর অর্ধেক বিভাগ পায়। বিভাগের টাকা কী হয় জানি না, কিন্তু শিক্ষকরা পাচ্ছে। আমি এটাও জানি, যাদের শুধু পিএইচডি আছে, শুধু তারাই ক্লাস নেয়। এগুলো বিবেচনায় নেয়া দরকার। তিনি বলেন, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভেনিং কোর্সের ছড়াছড়ি। নিয়মিত গ্রাজুয়েট ছাড়াও হাজার হাজার গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট বলেন, আবার কিছু সংখ্যক শিক্ষক যারা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। কিন্তু ইভেনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে তারা খুবই সিরিয়াস। কারণ, এগুলোতে নগদ প্রাপ্তি থাকে। মনে রাখবেন, বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সুতরাং, এর জবাবদিহিও জনগণের কাছে। প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, শিক্ষার মূল লক্ষ্য জ্ঞানার্জন হলেও তা একমাত্র লক্ষ্য নয়। কারণ কর্মবিমুখ শিক্ষা মূল্যহীন। শিক্ষাকে কার্যকর করতে হলে এর সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার বিশ্বকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে জাতি যত বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারছে, সে জাতি তত বেশি উন্নতি করছে। এই পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রাখে যুব সমাজ। তারাই জাতির ‘চেঞ্জমেকার’। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু জ্ঞান দান করা নয়, বরং অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোই হচ্ছে আসল কাজ। গবেষণা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ। তাই গবেষণার মান বাড়াতে হবে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গবেষণা ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। যুগের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চলছে। বহির্বিশ্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং উন্নয়নেও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. তাকাকি কাজিতা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে নতুন প্রজন্মের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বিজ্ঞান হচ্ছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই তরুণ প্রজন্মকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরও বেশি সম্পৃক্ত ও মনোযোগী হতে হবে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us