পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে আরো দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে পাতাল রেল। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে এ দুটি প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে মেট্রোরেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের পাশাপাশি এমআরটি লাইন-১ ও ৫-এর নর্দান রুট বা উত্তরাংশ শীর্ষক মেট্রোরেল দুটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যার ঋণ সহায়তা দেবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এমআরটি লাইন-১ এ ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশটি হবে দেশের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল বা পাতাল রেল। এটা বাস্তবায়নে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। অবশ্য মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রকল্প সমাপ্তিতে এই বাস্তবায়ন খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ শহর। যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৪৪ হাজার ১০০ জন মানুষ বসবাস করে। ঢাকা মহানগরী ও পাশের এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ট্রিপ তৈরি হয়। আর ২০২৫ সালে এই ট্রিপের পরিমাণ ৪ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৩৫ সালে ৫ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হবে। পাতাল রেল চালু হলে কিছুটা হলেও এই চাপ কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মেট্রোরেলের লাইন-১ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত হবে আন্ডারগ্রাউন্ড বা পাতাল রেল। যার মোট স্টেশন সংখ্যা ১২ টি। এমআরটি লাইন-১ বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। লাইন -১ বিমানবন্দর রুট থেকে শুরু হয়ে টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে কমলাপুরে এসে শেষ হবে। এখানে পাতাল রেল হবে ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। এখানে ২০০টি কোচ কেনা হবে। যেখানে প্রতিটি সেটে আটটি করে কোচ থাকবে। এই অংশে ১৯টি স্টেশনের মধ্যে পাতালে থাকছে ১২টি স্টেশন। এই অংশে জাইকার ঋণ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। এই অংশ বাস্তবায়নেও জাইকার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হবে বলে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে। এই অংশে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। যেখানে প্রতি হেক্টর জমির দাম পড়ছে ৫৯ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এমআরটি লাইন-৫-এর নর্দান রুটের মধ্যে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে পাতাল রেল যাবে। আন্ডারগ্রাউন্ডে মোট ৯টি স্টেশন হবে। এটি সাভারের হেমায়েতপুর থেকে বলিয়ারপুর, মধুমতি, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুনবাজার হয়ে ভাটারায় শেষ হবে। এমআরটি লাইন-৫-এর নর্দান রুটটির নির্মাণকাজ ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা।অন্যদিকে, এমআরটি লাইন-৫-এর সাউদার্ন রুট তথা দক্ষিণাংশ নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সাল। এ অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭.৪০ কিলোমিটার। যার মধ্যে পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ড হবে ১২.৮০ কিলোমিটার। এ রুটে ১৬টি স্টেশনের মধ্যে ১২টি হবে পাতাল রেলের। এরই মধ্যে এমআরটি লাইন-৫-এর সাউদার্ন রুটের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে। এ রুটে নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ অংশে মেট্রোরেলটি গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ, সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরঝিল, নিকেতন হয়ে রামপুরা পর্যন্ত যাবে।এমআরটি লাইন-১ সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পাতাল রেলের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের কাজ অর্থাৎ ড্রইং, ডিজাইন, সার্ভে ইত্যাদি কাজ শুরু হয়ে গেছে। পাতাল রেলের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে ২০২২ সালে। পাতাল রেলের অংশটুকু এলিভেটেড (উড়ালপথে) করতে গেলে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে। সে কারণেই মূলত পাতাল রেলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে উপরে সমস্যা কম হবে। তাই আন্ডারগ্রাউন্ডে টানেল করে খুব সহজেই কাজ সম্পন্ন করা যাবে। আর এলিভেটেড (উপরিভাগে) হলে রাস্তা ব্লক হবে। জনদুর্ভোগ বাড়বে। নির্মাণ কাজের সময় ট্রাফিক সমস্যা থেকে শুরু করে আরো অনেক সমস্যা বেড়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে আলাদাভাবে কোনো খরচ ধরা হয় নি। আন্ডারগ্রাউন্ড এবং এলিভেটেড মিলিয়ে যৌথভাবে প্রকল্প ব্যায় ধরা হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ডের মাটি অপসারনের বিষয়টি কিছুটা চিন্তার বিষয়। এ বিষয়ে অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে মাটি সরানোর ব্যবস্থা করা হবে। পূর্বাচলের ওই অংশটুকুতে পর্যাপ্ত জমি না থাকায় এবং যাত্রীদের চাপ কম থাকায় এই অংশটুকু এলিভেটেড করা হচ্ছে। এদিকে ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় মাটি ফেলার জায়গা না পেয়ে জটিলতার মুখে পড়েছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। ঢাকার বিভিন্ন রুটে প্রস্তাবিত পাঁচটি মেট্রোরেলের নির্মাণ অগ্রগতি পর্যালোচনা বৈঠকে বিষয়টি উঠে আসে। এতে জানানো হয়, ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল (পাতাল) নির্মাণে সবচেয়ে জটিলতা হবে মাটি অপসারণ ও তার ব্যবহার নিয়ে।প্রকল্প সূত্র জানায়, ঢাকায় পাতাল রেল হবে সড়কের ১৫০ থেকে ২০০ ফুট নিচে। আর স্টেশনগুলোর আকার হবে কয়েক হাজার বর্গফুট ও তিন-চার তলাবিশিষ্ট। এতে পাতাল রেলের টানেল ও স্টেশন থেকে প্রচুর মাটি অপসারণ করতে হবে। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় এত পরিমাণ মাটি ফেলার মতো পর্যাপ্ত নিচু জমি নেই। কিছু স্থানে নিচুজমি বা খাল থাকলেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সেখানে মাটি ফেলা সম্ভব নয়। তাই মেট্রোরেলের মাটি ফেলার জন্য একাধিক বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রস্তাবিত পাতাল রেলের মাটি অপসারণ এবং তা ফেলতে যে ব্যয় হবে, তা দিয়ে উড়ালপথে আরেকটি মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব। পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যায় ও সময়সাপেক্ষও। তাই কম ব্যয়ে ও সাশ্রয়ী সময়ে কীভাবে মাটি অপসারণ করা যায়-তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত চাওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মাটি ফেলার জন্য সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য নিচু জমি ভরাটে প্রচুর বালি ও মাটি দরকার হবে। এক্ষেত্রে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেলের মাটি সরবরাহ করা যায় কি না তা বিবেচনা করা হচ্ছে। পাতাল রেলের জন্য সাবওয়ে স্থাপিত হলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার নিচ দিয়ে চলবে যাত্রীবাহী ট্রেন। এতে মহানগরীর প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এতে মাটির ওপরে রাস্তায় মানুষের চলাচল কমবে। বাড়বে ফাঁকা জায়গা। দূর হবে যানজট। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মাটির ২০ থেকে ৪০ মিটার গভীরে পাতাল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। অত্যাধুনিক টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) ব্যবহার করা হবে এ কাজে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় জনদুর্ভোগ হবে না। মাটির ওপরে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে না। উড়ালসড়ক, ফ্লাইওভারের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ৫০ থেকে ৭৫ বছর। পাতাল রেলের আয়ুষ্কাল ১০০ থেকে ১২৫ বছর। লন্ডনের শতবর্ষী পাতাল রেল এখনো সচল রয়েছে। যানজট নিরসনে লন্ডন ছাড়াও নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, বাগোটার মতো শহরে উড়ালসড়ক, ফ্লাইওভার, ভায়াডাক্ট অপসারণ করে সাবওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) খান মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, এমআরটি লাইন-১ ও ৫ পাতাল রেল অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ডে খরচটা একটু বেশি হবে। জাইকা বলেছে, আন্ডারগ্রাউন্ডে তিনগুন খরচ বেশি হবে। সেখান আমরা দর কষাকষি করে খরচ দ্বিগুনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছি। এটা হচ্ছে সম্ভাব্য বরাদ্দ। আশা করছি প্রকল্প খরচ আরো কমবে।