বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যাদের যাতায়াত তাদের প্রায় সবাই চেনেন আবদুর রহমানকে। স্টেডিয়াম এলাকার চেনামুখ আবদুর রহমান বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের নৈশপ্রহরী। স্টেডিয়ামে খেলা থাকলে প্রেসবক্সে মিডিয়া কর্মীদের সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। এসবের বাইরেও তার আরেকটি পরিচয় আছে। নিজের নামে ফুটবল একাডেমি গড়েছেন রহমান। গত দুই মৌসুম ধরে পাইওনিয়র ফুটবল লীগে অংশ নিচ্ছে তার নামে গড়া ‘রহমান ফুটবল একাডেমি’। পল্টন আউটার স্টেডিয়ামে প্রতিদিন বিকালে এই একাডেমির শ’খানেক কিশোর ফুটবলার অনুশীলন করে। কেরানীগঞ্জ, ফকিরাপুল, সেগুনবাগিচা, মিরপুর এমনকি নারায়ণগঞ্জ থেকেও কিশোর ফুটবলাররা এসে অনুশীলন করে রহমানের একাডেমিতে। বিনা খরচে এসব ফুটবলারদের অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি সবাইকে জার্সিও কিনে দিচ্ছেন নিজের পয়সায়। চট্টগ্রামের রাজাখালী গ্রামে আবদুর রহমানের বাড়ি। মাত্র পাঁচবছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন। ওই বছর ঘূর্ণিঝড়ে বাবাও মারা যান। এরপর ভাইয়ের সংসারে আর ঠাঁই হয়নি। গ্রাম থেকে ভাগ্য বদলের আশায় চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। শহরের শুঁটকির বাজারে কিশোর বয়সেই কুলির কাজ করতেন। সে কাজে মন বসেনি। এক বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন রহমান। কমলাপুর, সদরঘাটে ঘুরে কিছু একটা করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কোনো কাজই পছন্দ হয়নি। পরে ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা তাকে প্রেসবক্সে সহকারীর কাজ দেন। এরপর থেকে স্টেডিয়ামই রহমানের ‘ঘরবাড়ি’। পল্টনের হ্যান্ডবল ফেডারেশনে ঘুমান। বছর চারেক আগে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনুর তাকে নৈশপ্রহরীর চাকরি দিয়েছেন।জন্মগতভাবেই প্রতিবন্ধী আব্দুর রহমান। কথাবার্তা স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। জন্মেছিলেন দুটি কাটা কান নিয়ে। সম্প্রতি পেটে ব্যথ্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারেন তার মাত্র একটি কিডনি। একটি কিডনি ও নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে চলছেন রহমান। বিভিন্ন জনের সাহায্যে চলছে তার চিকিৎসা। তবে নিজের চিকিৎসার চেয়ে রহমান বেশি মনোযোগী তার একাডেমির দিকে। এত কিছু থাকতে ফুটবল একাডেমি গড়ার শখ কেন? রহমান বলেন, ‘রাস্তাঘাটে দেখি ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নেশা করছে। আজেবাজে কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এসব দেখেই একদিন কয়েকজনকে বলি, ভাই তোরা আমার কাছে এসে ফুটবল খেলিস। কিছু ছেলে আমার কথায় খেলতে আসে।’ দশ বছর আগে একটু একটু করে একাডেমি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন রহমান। প্রথমে নাম দিয়েছিলেন সেভেন স্টার ফুটবল একাডেমি। ফুটসাল ও ‘টোকাই’ ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলেছে এই একাডেমির ছেলেরা। গত বছর হবিগঞ্জে প্রীতি ফুটবলে হয়েছিল রানার্সআপ, কেরানীগঞ্জে মান্ডাইল ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। এ ছাড়া আরো বহু টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে রহমান ফুটবল একাডেমি। বিভিন্ন সময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া অল্প কিছু জমানো টাকা দিয়ে একাডেমির কার্যক্রম শুরু করেন রহমান। মাঝে মাঝে বল কেনার টাকাটাও জোগাড় করতে পারেন না। ফুটবল ফেডারেশনে বেশ কয়েকবার বলের জন্য লিখিত আবেদন দিয়েছিলেন। কিন্তু সাড়া পাননি। তাতেও থামেন নি এই ফুটবল প্রেমীপাইওনিয়র ফুটবল লীগের তার দলের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে রহমান বলে, ২০১৭ সালে পাইওনিয়র ফুটবল লীগে প্রথম অংশ নেয় রহমান ফুটবল একাডেমি। প্রথমবার অংশ নিয়ে পেশী শক্তির কাছে হার মানতে হয় আব্দুর রহমানকে। প্রথমবার লীগে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে রহমান বলেন, প্রথমবারের ছয় খেলার মধ্যে তিনটিতে আমরা জিতেছিলাম। বাকি তিন ম্যাচে হেরেছি জোরের কারণে। লীগ কমিটি একটি বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিলেও দলগুলো সে নিয়মের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু আমার দল নিয়ম মেনেই অংশ নিয়েছিল। যে কারণে বড়দের সঙ্গে আমার দল কুলিয়ে উঠতে পারেনি। এবারো আমার একাডেমির অবস্থা ভালো না। এ পর্যন্ত ছয়টি ম্যাচ হয়েছে। যার মধ্যে তিনটিতে জয় দুটিতে হেরেছি আমরা। সামনের ম্যাচে জিতলেও নকআউট পর্বে আমাদের যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর কারণ হিসেবে রহমান বলেন, আমি যতটুকু শুনেছি সামনের ম্যাচে আরামবাগ ফুটবল একাডেমিকে ছেড়ে দিবে মাদারবাড়ী। এই পাতানো ম্যাচের কারণেই আমরা বাদ পড়বো। প্রতিটি ম্যাচে ১২-১৫ হাজার টাকা খরচ হয় রহমানের। এই অর্থের যোগান কিভাবে আসে জানতে চাইলে রহমান বলেন, আমি যা আয় করি তা দিয়ে একাডেমি চালানো প্রায় অসম্ভব। আমি একাডেমি চালাই মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে। তাছাড়া আমার একাডেমির একটি উপদেষ্টা কমিটি আছে তারাও আমাকে সাহায্য করে। হ্যান্ডবল ফেডারেশনে নৈশপ্রহরীর কাজ করে মাসে ৮ হাজার টাকা সম্মানী পান রহমান। মিডিয়া বক্সে কাজ করলে পান ৪শ’ টাকা। এ ছাড়া ফুটবল ম্যাচে বলবয় দিয়ে কিছু আয় হয় রহমানের। এসব দিয়ে ফুটবলার তৈরির কারখানা গড়েছেন যুব সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে। নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে একাডেমি চালাতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন রহমান জানান, আমি চেয়ে চিন্তে একাডেমি করলেও ফুটবল ফেডারেশন কিংবা লীগ কমিটি কারো কোনো সাহায্য পাই না। এমনকি আউটার স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতেও দেয়া হয় না আমার দলকে। নানা হুমকি-ধমকিও দেয়া হয় আমাকে। এসব চিন্তা করে মাঝে মাঝে একাডেমি বন্ধ করে দেবার মন চায়। আবার চিন্তুা করি এদের উপর রাগ করে গরিব ছেলেদের নেশার দিকে ঠেলে দিয়ে লাভ কি?সারা দেশে এখন সেভাবে ফুটবলের জোয়ার নেই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও যখন তাদের একাডেমি ঠিকঠাক মতো চালাতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্লাবে যেখানে একাডেমি কার্যক্রম অনুপস্থিত। সেখানে জন্মপ্রতিবন্ধী রহমান একাডেমি চালিয়ে যাচ্ছেন, মাদককে দূরে ঠেলে দিয়ে ফুটবলের এক সোনালি দিনের স্বপ্নে।