আমরা যারা ইতিহাস থেকে সত্য ধারণ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের মহান স্মৃতি যাদের বুকের ফটোপ্লেটে এখনো উজ্জ্বল, দলপ্রেম নয়-দেশপ্রেম যাদের ধমনিতে, সুবিধাবাদ যাদের আকর্ষণ করতে পারেনি, তারা দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে কলুষমুক্ত দেখতে চায়। আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষতায় দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন তাদের আমোদিত করে। তারা দেখতে পান তেমন কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য পূরণের সুযোগ রয়েছে। তবে শঙ্কা সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন সব অর্জনকে না নড়বড়ে করে দেয়!
এ সরকারের শুভার্থী হিসাবে আমাদের ভেতর কিছু শঙ্কার কালো মেঘ জমাট বাঁধছে। বারবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও সরকারের পরিচালকরা দলীয় বৃত্তে আটকে গিয়ে মুদ্রার দুটো পিঠই কি দেখতে পাচ্ছেন? কারণ চারপাশে নানা পেশাজীবী ধামাধরা চাটুকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রকৃত সংকট তারা সরকারপ্রধানের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রাখতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতা ও শক্তির মোহে নানা খানাখন্দ কি দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে? পাহাড়ে ওঠা কঠিন-তবে স্বস্তি, এ কাঠিন্য অনেকটাই জয় করতে পারছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দৃঢ় নেতৃত্বে। কিন্তু মুহূর্তের ভুলে বা বিভ্রান্তিতে পতন কিন্তু এক লহমায় হয়ে যেতে পারে। আমার এক স্কুলশিক্ষক বলতেন আত্মম্ভরিতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়।
ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ড এ দেশে নতুন নয়। যখন থেকে ছাত্র রাজনীতি অঙ্গ বা সহযোগী যে নামেই হোক মূল দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তখন থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতির শক্তিতে খুনোখুনির মাত্রাও বেড়ে যায়। এক সময় ছাত্রশিবিরের রগ কাটা রাজনীতির বিভীষিকা ছড়িয়েছিল বিশেষ করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামের অঙ্গ। ওদের রগ কাটা ইমেজ বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের হিংস্র চেহারা আমরা ভুলতে পারি না। সুতরাং এ দলটির অঙ্গ তো আর ভিন্ন আচরণ করবে না। অন্যদিকে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েই তো জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা করেছিলেন। অস্ত্র আর অর্থ তুলে দিয়ে ছাত্রদলের যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ও খুনোখুনি কম হয়নি। আর এ দলের বাই প্রডাক্টই ছিল জেনারেল এরশাদের ছাত্রসমাজ। তাই অস্ত্রচর্চা এরাই বা কম করবে কেন!
আবরার হত্যা, এর আগে বিএনপি আমলে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনি হত্যা, এসব মর্মান্তিক স্মৃতির কারণে বুয়েটের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এটি বেশিদিন হজম করতে পারেননি সরকারদলীয় রাজনীতিকরা। নানা কায়দাকানুন করে আবার ছাত্রলীগ রাজনীতি পুনর্বহাল করে বুয়েটে। এর সবই দেশবাসী জানেন।
মানুষ তো সুন্দরের স্বপ্ন বুনতেই পছন্দ করে। আশা নিয়েই নাকি মানুষের বাঁচা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মানুষ শুভ প্রত্যাশা কিছুটা করেছিল। ভেবেছিল ঐতিহ্যবাহী দল ছাত্রলীগ, যার বয়স আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি, নানা গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থেকে নিজের উজ্জ্বল ঐতিহ্য গড়েছে দলটি, সে গৌরবের ছাত্রলীগে বেড়ে ওঠা আজকের আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা দলে ও সরকারে থেকে একটি শোভন ছাত্র রাজনীতির দীক্ষা দেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ যুগে এসে ছাত্রলীগকে সেই মার্জিত রূপে আমরা দেখতে পাইনি। ছাত্র রাজনীতি ষণ্ডাতন্ত্রে আটকে যাওয়ায় ক্যাম্পাসে মেধাবীরা রাজনীতিবিমুখ হয়েছে। অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির মোহে এরাও আসক্ত হয়ে পড়েছে। সুস্থ রাজনীতি চর্চা না থাকায় কখনো শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, আবার কখনো শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্রলীগে নাম লেখানো তরুণদের দলের লাঠিয়াল বানানো হয়েছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভালো হতে পারে না।
আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমস্যা আমরা দেখতে পাই, তারা দেশের মানুষকে বোকা ভাবতে পছন্দ করেন। তাই এমন সব কথা বলেন, যা আসলে সচেতন মানুষকে বিরক্তই করে। এ সচেতন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। একজন স্বল্পশিক্ষিত রিকশা ড্রাইভারের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুনলেও অবাক হতে হয়। তাই এ দেশের বড় সংখ্যক মানুষ-যারা দলীয় রাজনীতির আফিমে বুঁদ নন, তাদের কাছে নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই। যেমন আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের কণ্ঠে শুনেছিলাম-এটি নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দায় ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেবে না। এ ছেলেদেরও দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এখন নিজ ঘর ঠিক রাখতে চায়। তাই অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ কর্মীরা বলি হলেও নেতৃত্বের কিছু যায়-আসে না। তারা নিরপেক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসাবে নিজেদের নাম প্রচার করতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সব ক্যাম্পাসেই যে ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী বখাটে হয়ে গেছে, এ সত্য তো তারা স্বীকার করতে চাইছেন না। এখানেই আমাদের আশঙ্কার জায়গা।
এই যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগ এক রকম জিম্মি করে রেখেছে, তা কি কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন না? মিছিলে না গেলে, ছাত্রলীগের বড় ভাইদের আদেশ না শুনলে বা ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাদের যে গেস্টরুমে বা তথাকথিত টর্চার সেলে নিপীড়ন করা হয়, হল প্রশাসন প্রায়ই প্রতিবিধান না করে অক্ষমতা প্রকাশ করে, এ কথা কি কারও অজানা? নেতারা উচ্চাসনে বসার কারণে যদি না-ই দেখতে পান, এতসব গোয়েন্দা সংস্থা কী রিপোর্ট দেয়? নাকি দাপট দেখিয়ে চলার মধ্যেই বীরত্ব দেখছেন। বাহবা দিচ্ছেন!