ঘরে পানি। বাইরে পানি। চারদিকে থৈ থৈ পানি। এরই মাঝে বাস করছে বানভাসিরা। কেউ ঘরের চালায়। কেউবা মাচা বেঁধে বাস করছে। খাবারের কষ্ট, আবার বৃষ্টি হলে পানিতে ভিজছে। বানের পানির কারণে দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণও পৌঁছাতে পারছেন না ইউপি চেয়ারম্যানরা। এ অবস্থায় এক নিদারুণ কষ্টে দিন যাচ্ছে বানভাসিদের। কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, নাটোর, জামালপুর, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে রয়েছে বিস্তারিত।ভাসছে চিলমারী, শহর ছাড়ছে মানুষচিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, শহরে ঢুকছে পানি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বন্যার পানি। চিলমারী ভাসছে এখন পানিতে। বাসাবাড়ি, অফিস, আবাসিক এলাকা, সরকারি অফিস, বাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার সবই তলিয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুরো চিলমারী এখন পানিতে ভাসছে। শহরের রাস্তায় গাড়ির বদলে চলছে নৌকা আর ভেলা। বাসাবাড়িতে পানি উঠায় বেশির ভাগ মানুষ শহর ছাড়ছে। ছুটে চলছে একটু আশ্রয়ের সন্ধানে উঁচু কোনো স্থানে বা আত্মীয়ের বাড়িতে। উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারাও ছাড়ছে সরকারি ভবন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সরকারি আবাসিক কোয়ার্টারের নিচতলায় হাঁটুর উপর পানি উঠায় এবং পরিষদের রাস্তায় অনেক বেশি পানি থাকায় নেই বের হওয়ায় উপায়। চারদিকে পানি থাকলেও রয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নয় শহরের প্রায় মানুষ ছুটছে এখন নিরাপদ স্থানে। আবার অনেকে গরু-ছাগল নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। পাচ্ছেন না কোনো উঁচু স্থান ফলে পানিতেই রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বিভিন্ন স্থানে সড়ক, রেল সড়ক ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরে পানি বাড়ছে। পানিতে টিউবয়েল, ল্যাট্রিন তালিয়ে যাওয়ার মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। শুধু তাই নয় টাকা দিয়েও মিলছে না খাদ্য। নুরুল আমিন নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, মাটিকাটা মোড় এলাকায় একটি দোকানে ভাত খেতে গেলে মেলেনি একটি ডিম ভাজি। ভাত মিললেও বসে থাকতে হয়েছে বেশ সময় ধরে। তিনি বলেন, এর মধ্যে অনেককেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। জনগণের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকার বীর বিক্রম বলেন, কিছু মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। আবারও এসেছে। কিন্তু চারদিকে পানির কারণে ইউপি চেয়ারম্যানগণ বরাদ্দকৃত চাল এলাকায় নিতে পারছেন না। এদিকে বন্যার পানির তোড় থেকে উপজেলার বেশ কিছু এলাকা থেকে আটকে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান চিলমারী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা।ভেঙে গেল ভূঞাপুর-তরাকান্দি মহাসড়কভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, বানের পানির তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-তারাকান্দি মহাসড়ক। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে সড়কটির বেশ কিছু অংশ ভেঙে পানি ঢুুকে যায়। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরো ১০টি গ্রাম। এ নিয়ে বর্তমানে উপজেলার ৫০টি গ্রাম পানিবন্দি। ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। শহীদ সালাউদ্দীন সেনানিবাস বঙ্গবন্ধু সেনানিবাসের ১৮ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ানের সেনাসদস্যরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ভূঞাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ এ বাঁধটি রক্ষার জন্য সেনা মোতায়েনের দাবি উঠেছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। সড়কটি ভাঙার আগে সেনা মোতায়েন করা গেলে হয়তো এতবড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। এত মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এজন্য প্রশাসনের দুর্বলতাকেই দায়ী করেছেন তারা।এদিকে যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার প্রায় ৫০টি গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় পৌরসভার টেপিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পানির স্রোত বইছে। হুমকির মুখে রয়েছে বিদ্যালয়টি। তীব্র স্রোতে নদীর পানি প্রবেশ করায় ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি রাস্তঘাট ও ঘরবাড়ি। বন্যাকবলিত মানুষজন গবাদিপশু নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। রাস্তার দুই পাশে এবং উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যাকবলিত মানুষজন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার ত্রাণসামগ্রী পায়নি তারা।উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫টি মাদ্রাসা ও ৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করায় সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মধ্যে ২০০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। তবে বানভাসি বেশিরভাগ মানুষ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝোটন চন্দ জানান, বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অস্বাভাবিকহারে পানি বৃদ্ধির ফলে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক ভেঙে গেছে। সড়কটিতে কাজ করছে সেনাবাহিনী।টাঙ্গাইলের পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, ভূঞাপুরে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পরিস্থিতি গতকাল বিকাল পর্যন্ত অবনতি হওয়ায় সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া উপজেলার ভিবিন্ন অংশ ভাঙনরোধে জিওব্যাগ ফেলার কাজ চলছে।সিংড়ায় ব্রিজ ভেঙে ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ননাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বন্যার পানির স্রোতে বক্তারপুর ব্রিজ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে অন্তত ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে গতকাল দুপুরে হঠাৎ করে পানির স্রোতে ভেঙে পড়ে ব্রিজটি। এতে করে বক্তারপুর, গোবিন্দনগর, বারইহাটি, ডাকমন্ডব, বামনহাটসহ অন্তত ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ব্রিজ ভেঙে দ্রুত পানি নামার কারণে আশেপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতিজামালপুর প্রতিনিধি জানান, জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে জেলার ৭টি উপজেলায় মোট ৬১টি ইউনিয়ন ও ৬টি পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১৫৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব অঞ্চলের ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার পানি প্রবেশ করায় ৭ উপজেলায় মোট ৬৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৬০টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৮০টি মাদ্রাসা এবং ৪১টি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী বলেন, বন্যা দুর্গতদের জন্য ৬০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে এক হাজার ৫৭৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। জামালপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, বন্যার পানিতে রেলপথ প্লাবিত হওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ এবং জামালপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত রেলপথে আন্তঃনগর ট্রেনসহ সকল ট্রেন চলাচল এখনো বন্ধ রয়েছে।জগন্নাথপুরে দুর্গতদের জন্য প্রার্র্থনাজগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমছে। তবে দুর্ভোগ কমছে না দুর্গত মানুষের। গতকাল সকাল থেকে পানি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এদিকে জুমার নামাজের আগে জগন্নাথপুরের বিভিন্ন মসজিদে দুর্গতদের জন্য মোনাজাত করা হয়েছে। জানা যায়, অব্যাহত বৃষ্টি ও উজান থেকে থেকে আসা ঢলে গত এক সপ্তাহ ধরে উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের কান্দারগাঁও, নোয়াগাঁও, নাদামপুর, রানীগঞ্জ ইউনিয়নের রৌয়াইল, বাঘময়না, রানীনগর, আশারকান্দি ইউনিয়নের বড়ফেচি, মিলিত, মিঠাভরাং, কালাম্বরপুর, ঐয়ারকোণা, ধাওরাই, আটঘর, পাইলগাঁও ইউনিয়নের কাতিয়া, ফেচি, কসবা, রমাপতিপুর, মশাজান, সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর কোণাপাড়া, গোয়ালগাঁও, তেঘরিয়া, বুধরাইল, জগন্নাথপুর পৌর এলাকার আলখানাপার, হবিবনগরসহ জগন্নাথপুরের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৪০ গ্রামের লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যায় পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্যা গ্রামীণ রাস্তাঘাট, নদীর তীরবর্তী এলাকা ও নিম্নাঞ্চলের অনেকেই বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কিছুসংখ্যক পরিবারের লোকজন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। পাইলগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুখলিছ মিয়া মিয়া বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের ইউনিয়নের কমপক্ষে ১৫টি গ্রামের লোকজন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। গতকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে দুর্গত এলাকার লোকজনের দুর্ভোগও বেড়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা সদর জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আজমল হোসেন জামী বলেন, জগন্নাথপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে দুর্ভোগে পড়েছেন। দুর্গত এলাকার মানুষদের এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশবাসী রক্ষার জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে আমরা মোনাজাত করেছি। জগন্নাথপুরের ইউএনওর দায়িত্বে থাকা এসিল্যান্ড ইয়াসির আরাফাত বলেন, দু’দিনে ধরে আবহাওয়া ভালো থাকায় গতকাল থেকে পানি কমছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে সামান্য বৃষ্টি হলেও গত দু’দিনের মধ্যে আর বৃষ্টি হয়নি। তিনি বলেন, আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।