বহু গুণে গুণান্বিত এক মানুষ

মানবজমিন প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরও চলে গেলেন, না ফেরার দেশে। আমাদের প্রিয় জাহাঙ্গীর ভাই। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গুণের  কোনো শেষ নেই। অসাধারণ এক ব্যক্তি। মুখের হাসিটি অমলিন। একহারা গড়ন। খুব টিপটপ থাকতেন। সারাক্ষণ তার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করতো। কাজের উদ্যমে তিনি ছুটতেন। তিনি ছিলেন পরিকল্পনার রাজা। কত কিছুর পরিকল্পনা করতেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই নিত্যনতুন ভাবনাগুলো আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। বহু গুণে গুণান্বিত এক মানুষ। তার সাফল্য বহুবিদ। তিনি দীর্ঘদিন পেশাদারী সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি মিডিয়া বিষয়ক কলাম লিখেছেন পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়। প্রথম আলো’য় খুব গুরুত্ব দিয়ে তার লেখা ছাপা হতো। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রায় তার অসংখ্য ফিচার-নিবন্ধ ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। বিটিভিতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান তৈরি করেছেন। উপস্থাপনা করেছেন। মনে পড়ে একুশের সংকলন নিয়ে তিনিই দৈনিক বাংলার পেছন পাতায় দীর্ঘ ফিচার লিখতেন। একুশের সংকলন নিয়ে টিভিতেও অনুষ্ঠান করতেন। টেলিভিশনে প্রথম সরাসরি সম্প্রচারিত টেলিফোন অনুষ্ঠান তিনিই প্রথম উপস্থাপন করেন। আপনি কি ভাবছেন বা বিষয়ভিত্তিক ‘অভিমত’ অনুষ্ঠান তিনি দীর্ঘদিন উপস্থাপনা করেছেন। তবে দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা চ্যানেল আইয়ের পর্দায় প্রতি শুক্রবার সকালে লাইভ টেলিফোন অনুষ্ঠান টেলিসময় উপস্থাপনা করেছেন। সব কাজেই তিনি ছিলেন সিরিয়াস। অনুষ্ঠানটির নির্বাহী প্রযোজক জামাল রেজা। নির্দিষ্ট দিনে তিনি আমাদের বিষয় বলে দিতেন। আমরা যেন প্রমোশনাল দেই সেই ব্যাপারে তাগাদা দিতেন। অন এয়ারের দিন একঘণ্টা আগে উপস্থিত হতেন। হাতে ফাইল আর অনুষ্ঠানে কি বলবেন তা লেখা থাকতো। লিখিত ডকুমেন্ট ছাড়া জাহাঙ্গীর ভাই কোনো মুখের কথার গুরুত্ব দিতেন না। প্রচুর চিরকুট লিখতেন। তাতে বিভিন্ন নির্দেশনামা থাকতো। একদিন হাসতে হাসতে বললেন,চিরকুট না লিখলে আমরা যা বলি তা অস্বীকারও করি। কিংবা ভুলে যাই। তাই চিরকুট লিখে দেই। এই সৎগুণটি তিনি পেয়েছিলেন নোবেলজয়ী তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। এই ভ্রাতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তার জীবনের আইকন। তার আদর্শ। প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গে তিনি গর্বের সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলতেন। যা বলছিলাম টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন খুব ধীর স্থির ও শান্ত স্বভাবের। মডারেটর হিসেবে তিনি ছিলেন অসম্ভব দক্ষ। নিজে কথা কম বলতেন। আলোচকদের কথা বলার সুযোগ দিতেন। যে ব্যক্তিত্ব যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও জানাশোনা আছে তিনি তাদেরই নিতেন। যিনি অর্থনীতি জানেন তাকে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় নিতেন না। জাহাঙ্গীর ভাইকে কখনো ভুলভাবে প্রভাবিত করা যেত না। শেষ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিতেন। তার মতামতের সঙ্গে অমিল হলে তিনি সে কাজে অংশ নিতেন না। নিজের সমূহ ক্ষতি হবে জেনেও আপস করতেন না। বইমেলা নিয়ে সরাসরি যে অনুষ্ঠানটি এখনো আমরা প্রতিদিন বইমেলায় প্রচার করে থাকি। সেই অনুষ্ঠানের আইডিয়া দিয়েছিলেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের উপস্থাপনায় বইমেলা সরাসরি প্রথম অন এয়ার হয়। চ্যানেল আইয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপনা করেন। ‘মিডিয়া ভাবনা’ নামেও একটি অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন প্রচারিত হয় তার নেতৃত্বে। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর দৈনিক বাংলায় সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। নানামুখী সামাজিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। দু’চারটি তথ্য না দিলেই নয়। বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি ঢাকার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ‘বক্তব্য’ নামে একটি চিন্তামূলক পত্রিকা প্রকাশ করেন দীর্ঘদিন। নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় নির্বাহী হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। প্রায় ৪৮ বছর। জাহাঙ্গীর ভাই নৃত্যকলার চর্চা বৃদ্ধির জন্য শিবলী-নিপাকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠন করেছেন। অনেক রকম কাজ করতেন ‘নৃত্যাঙ্গন’- এর মাধ্যমে। থিয়েটার নাট্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিজে অভিনয় করতেন না। কিন্তু নাট্য সংগঠনের অন্যান্য কাজে সংযুক্ত থাকতেন। এক জীবনে তিনি কত যে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছেন সে হিসাব কেউ করতে পারতেন না। এ ছাড়াও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর খুব একাডেমিক ছিলেন। সাংবাদিকতা, লেখালেখি এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন ছিল। মনে পড়ে চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডের নীতিমালা তিনি লিখে দিয়েছিলেন। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির তিনি ছিলেন আহ্বায়ক। আমি ছিলাম নির্বাহী সদস্য। কী অসাধারণ গদ্যে তিনি সংক্ষেপে ফজলুল হকের জীবনী লিখে দিয়েছিলেন। প্রতি বছর স্মৃতি পুরস্কারের উদ্বোধন করতেন তিনি। এ বছর আর উপস্থিত থাকবেন না তিনি। হায়!জাহাঙ্গীর ভাইয়ের লেখা খুব সুন্দর। চিন্তার স্বচ্ছতা ছিল বলে যা লিখতেন তা খুব সহজ ও প্রাঞ্জল হতো। ছোটদের জন্যও তিনি তার জাদুকরী ভাষায় কিছু বই লিখেছেন। এমন উপভোগ্য বই বাংলা ভাষায় খুব কম লেখা হয়েছে। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও টুকটাক স্মৃতিকথাও লিখেছেন। বড় ক্যানভাসে আত্মজীবনী লিখবেন এমন আশা ছিল তার। আমাদের সঙ্গে দেখা হলেই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। অনেক স্বপ্নের কথা বলতেন। অসুখ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা বলিনি। কারণ তিনি ছিলেন খুব জীবনবাদী। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক মানুষ। প্রথমবার ব্যাংকক থেকে অপারেশন করে ফিরে এসে বলেছিলেন, আমীরুল পঁচিশ দিন পর জিভে একটু পানি ছোঁয়ালো। তখন উপলব্ধি করলাম এই জিভ দিয়ে জলপান করা কত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।জাহাঙ্গীর ভাই আরো বললেন, আরেকদিন তোমাদের অসুখকে জয় করার গল্প শোনাবো। শেষের দিকে জাহাঙ্গীর ভাই প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। একটু সুস্থ হলেই বাইরে নানা কাজে ছোটাছুটি করতেন। আমার আর আহমাদ মাযহারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ধানমণ্ডিতে বারবিকিউ নাইটে। শীতের সন্ধ্যা। আমরা কাবাব রুটি খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাহাঙ্গীর ভাই। বইমেলার খবর নিলেন। তার সহপাঠী আলী ইমাম, মহসীন রেজা, শামীম আজাদের প্রসঙ্গে কথা হলো।জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, মাযহার আর তোমার সঙ্গে একবার কলকাতা যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে। কলেজ স্ট্রিট, প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের ফুটপাথে তোমাদের সঙ্গে হেঁটে বেড়াবো। আমরাও হইচই করে উঠলাম, অবশ্যই। অবশ্যই যাবো। তারপর জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের নিউ ইয়র্ক বইমেলাতে যাওয়ার খুব ইচ্ছা করে। তোমরা তো প্রতি বছরই অংশ নিচ্ছো। বিশ্বজিতের দোকানটা তো খুব সুন্দর। তাই না?গল্প করা যায়। ডালপুরি আর শিঙ্গাড়া খাওয়া যায়। যেন একটুকরো বাংলাদেশ। খুব আবেগ নিয়ে সেদিন কথা বলছিলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আবার টেলিভিশনে কাজ করবো। আসছি চ্যানেল আইতে। শিশুসাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। আমীরুল ভালো হবে অনুষ্ঠানটি। বুঝলা?নিশ্চয়ই করবেন জাহাঙ্গীর ভাই। আপনি একদিন আসেন চ্যানেল আইতে। আসবো। সাগর এখন কেমন আছে? ভালো তো?মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের চ্যানেল আইতে আসা হয়নি আর। এই তো জীবন। এত আলোকিত উজ্জ্বল জাহাঙ্গীর ভাইও একদিন শেষ প্রস্থানের পথে হেঁটে যান। তার সঙ্গে আর দেখা হবে না। ১১.০৭.২০১৯
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us