মাকসুদা আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায় অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর পাঠকদের জন্য। আজ থাকছে ষষ্ট পর্ব-আমি গেলাম রায়নুলের অফিসে। তাদের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে তাদের মিডিয়া মার্কেটিংয়ের নিপা আপুর সাথে আমার ভালোই সখ্যতা তৈরি হয়। তার সাথে বিজ্ঞাপনের কো-আর্টিস্ট এবং তাদের বন্ধুদের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়। যাই হোক, নিপা আপু আমার সাথে রায়নুলের অফিসে বসে আছে। নিপা আপু শুটিংয়ের কিছু ছবি রায়নুল সাহেবকে দেখালেন। রায়নুল ছবিগুলো দেখে আমার দৈহিক গঠনের প্রশংসা করলেন। শিহাব আমাকে অনেক আগেই বলেছিল, রায়নুল সাহেব ধার্মিক মানুষ তার অফিসে যেন সব সময় শালীনভাবে যাই। আমি তাই করতাম। সুতরাং শুটিংয়ে যে ছবিগুলো দেখানো হয়েছে সেই ছবিতে আমার পোশাক রায়নুলের কাছে নতুন।হঠাৎ করে বলে উঠলেন, ‘নিপা তুমি একটু যাও, আমার প্রিয়তীর সাথে একটু প্রাইভেট কথা কথা আছে।’ নিপা আপু উঠে চলে গেলেন। তার অফিস রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি তখনও আন্দাজ করতে পারিনি যে, কিছুক্ষণের মাথায় আমার সাথে ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটতে যাবে। কী নিরুপায় আমরা তাই না, আমরা জানি না পরের মিনিটেই আসলে কি হতে যাচ্ছে......আমার মস্তিষ্ক হয়তো কিছুটা কাজ করা শুরু করল। আমাকে তিনি মনে হয় ধর্ষণ করবেন। এই অফিসে কেউ এখন ঢুকবে না কেউ জানবে না। যদি চিৎকার করি কেউ শুনবে না। শুনলেও আসবে না। আবার আসলেও আমাকে বিশ্বাস করবে না। সব তো তারই নিযুক্ত করা কর্মী। আমার হয়ে কেন কথা বলবে, কেন আমাকে বাঁচাবে? আমাকে বেশি রিস্কি মনে করলে আমাকে মেরে এখানেই গেঁথে রাখবে। কেউ জানবেও না কোনো পক্ষীও টের পাবে না। কে যাবে আমার জন্য খোঁজ নিতে? কে আছে আমার? কোথায় গিয়ে বিচার চাইবে?আমি আস্তে করে আমার শরীর থেকে যে বাধা দিচ্ছিলাম, তা ছেড়ে দিলাম। একটু সহনীয় হয়ে গেলাম। ঠোঁটের কোণায় একটু মুচকি হেসে বললাম, আজ না করলে হয় না? আজ না করি? আজ না করি? আমরা অন্য কোনোদিন সুন্দরভাবে সময় নিয়ে এক সাথে সময় কাটাই?’ আমার থেকে সম্মতি সূচক সিগন্যাল দিলাম।ওপরওয়ালা তার মস্তিষ্কের নোংরা চিন্তা-ভাবনাকে একটু হয়তো টুইস্ট করে দিল, কিছুক্ষণ পরে আমাকে ছেড়ে দিল।আমি আমার কাপড় গোছাচ্ছি, আমার ভিতরটা থরথর করে কাঁপছে নিজেকে আবর্জনা মনে হচ্ছে। একটাই লাইন আমার মাথায় শুধু কাজ করছে, ‘আমাকে এই রুম থেকে এ অফিস থেকে নিরাপদে বের হতে হবে।’ তার কাপড় ঠিক করতে করতে কি কি হাবিজাবি যেন আমাকে বলল। তার মধ্যে কিছু কথা আমার কানে এসেছে। আমাকে বলছিলেন, আমি অসহায় মানুষ, সে আমাকে মাসে মাসে ভরণপোষণের জন্য লাখ লাখ টাকা দেবে, ফ্ল্যাট দিয়ে দিবে, তার বিনিময়ে রায়নুলকে যেন একটু দেখাশোনা করি আমি। আরো কি কি যেন আমার কানের ওপর দিয়ে ভেসে চলে গিয়েছে। কেমন যেন কোনো কিছুই আমার স্নায়ুগুলোকে জাগাতে আর পারবে না এমনই মৃত একটা অনুভূতি।পাঁচ বছরের মৌখিক চুক্তি ছিল ওই বিজ্ঞাপনের জন্য, ১০ লাখ টাকা প্রতি বছর এই হিসাবে ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু সেই অংকের বিপরীতে জনাব রায়নুল শুধুই ৫০ হাজার টাকার এক বান্ডিল আমার বরাবর ছুঁড়ে মারলেন। ঠিক যেমন এক ছোটলোক খদ্দেররা যৌনকর্মীর সাথে থাকার পর ছুঁড়ে মারে, ঠিক ওইরকম।আমাকে জনাব রায়নুল বললেন, ‘কাল আইসা বাকি টাকা নিয়েন।’ আমাকে ১১টার পর তার অফিসে আসতে বলল। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক থাকার, আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। আর তাকে স্বাভাবিক দেখানোর জন্য ওই ৫০হাজার টাকার বান্ডিলটা ব্যাগে ঢুকালাম। ৫০হাজার টাকা মানে পাঁচশ’ ইউরো। এই পাঁচশ’ ইউরো না নিলে কি ক্ষতি হতো, কিছুই না। কিন্তু নিতে হয়েছে। আমার নিঃশ্বাস আটকে আছে, রুম থেকে বের হলেই হয়তো নিতে পারব। জনাব রায়নুল তার দরজার সুইচ চেপে দরজা খুলে দিলেন, আর আমাকে বের হতে দিলেন।আমি নিপা আপুর রুমে সরাসরি গেলাম, তার চোখাচোখি হওয়ার পর এক সেকেন্ড নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। কি হয়েছিল আমার সাথে রায়নুলের রুমে আমি তা বললাম। আমার তো আর ওই মুহূর্তে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার শক্তি নেই, তারপরে বলেছি যতটুকু পারি আমি কোন পরিস্থিতি থেকে বেঁচে এসেছি তা শুধু আমি জানি। ঘটনা বলতে বলতে আর কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না। সে নিজেও নিরুপায়, জানি তার কিছুই করার নেই আমার পিঠে হাত দিয়ে মালিশ করা ছাড়া। আমার ওই অফিসে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর এক মুহূর্ত থাকতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিলেন, আমি রওনা দিলাম।ট্যাক্সির মধ্যেই শিহাবকে ফোন দিলাম। ফোন দিয়ে চিৎকার করে জানালাম কি ঘটেছে আমার সাথে এ আমার মনেই নেই গাড়ির মধ্যে যে একজন অপরিচিতি ট্যাক্সি ড্রাইভার রয়েছে। গালাগালি দিয়ে সমস্ত রাগ ঘৃণা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। কোনো লাভ হয়নি তাতে। সে নির্বিকার চুপ করেছিল। কোন টুঁ শব্দ করেনি। কেন করেনি? জানি না।ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সুমনের বাসার ঠিকানা দিয়ে বললাম সেখানে নিয়ে যেতে। সুমন নিপা আপুর ভাইয়ের বন্ধু। কিছুদিন হলো পরিচয় হয়েছে, একটু প্রণয় প্রণয় ভাব। ওই যে ক্রাশ হলে যা হয়। তার কাছে গেলাম, আমি ওই অবস্থায় আমার ভাইয়ের বাসায় যেতে চাইনি। আমার চিৎকার করা লাগবে, চিৎকার। আমার নিজের শরীর খুব নোংরা লাগছে নিজের কাছে। মনে হচ্ছে রায়নুল যেখানে যেখানে তার নোংরা স্পর্শ লাগিয়েছে তা কেটে ফেলে দেই। কখনো নিজের শরীরের অঙ্গকে আপনার কাছে নোংরা লেগেছে? আমার লাগছিল প্রচণ্ড। আমি যাই সুমনের কাছে, তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদি। জানি না তার কাছে ওই টিশার্ট-টা এখনো আছেয কিনা, যেখানে আমার কাজল আর লোনা জল মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। চিৎকার করে বলতে থাকি রায়নুল কি কি করেছে আমার সাথে। মুখ ফুটে শব্দ উচ্চারণ করতে পারি না, কিছু জায়গায় গিয়ে তো আটকে যাই, এত শক্তি কোথায় পাব বলেন? সব তো শেষ আমার। কোথা থেকে আনবো সেই সাহস?একজন নারী পর্যন্ত সেই তীব্র যন্ত্রণার, সেই তীব্র কষ্টের গভীরে যেতে পরবেন না, যদি না তার সাথে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। আর এক পুরুষ মানুষই বা কতদূর পর্যন্ত এসেই কষ্টের অতলে যেতে পারবে? কিভাবে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করব নিজের সেই অঙ্গগুলোর নাম, যেখানে রায়নুলের নোংরা স্পর্শ লেগেছে? কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই আঘাতের সম্পূর্ণ বর্ণনা দেয়ার মতো শব্দের ভা-ার আমার কাছে ছিল না। সুমনকে যতখানি সম্ভব খুলে বলে আমি তার টিশার্ট চেপে ধরে চিৎকার করেছি, কিন্তু সেই চিৎকারে তো আমার যন্ত্রণাগুলো ছেড়ে চলে যাচ্ছে না ঘরের রুমের দেয়াল, দরজার সব ছোট হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমাকে চেপে ধরে মেরে ফেলবে। সেই তখন থেকে যে আমার বিনিদ্র রাত যাপন শুরু হলো আজও রাত জেগে যাই, রাত জাগতে জাগতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, তখনো আমার দুই চোখের পাতা এক হয় না, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমাকে ঘুমাতে হয়। এত কিছু বাইরের পৃথিবীর কাছে সব অজানা। কেউ একটু চুল পরিমাণ টের পায়নি, টের পাচ্ছেও না কি হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে। যেমন এই ঘটনার পরও আমার আগে থেকে যেখানে যেখানে কথা দেয়া ছিল কোন কাজের বা শুটের বা আমন্ত্রণের আমি সেই কথাগুলো রেখেছি এবং করেছি। ওই যে একটা কথা আছে না, ‘দি শো মাস্ট গো অন।’ নিজের ব্যক্তিগত কারণের জন্য বাইরের কাছে আমি কখনো ব্যাঘাত ঘটাইনি, এটি আমার অভিধানে নেই। চোখের ভিজে যাওয়া কাজল মুছে, মুখের ওপর গ্ল্যামারাস মাস্ক লাগিয়ে ঠোঁটের ওপরে কৃত্রিম হাসি চেপে ধরে আমি আমার কাজ তখন থেকে আজ অব্দি চালিয়ে যাচ্ছি।ঘটনার পরের দিন যখন আমি আর জনাব রায়নুলের কাছে তার সময় অনুযায়ী তার অফিসে যাইনি, তার নিশ্চয়ই বুঝতে দেরি হবার কথা নয়, আমি কেন যাইনি। এই মানুষগুলো টাকা দিয়ে সবকিছু কিনতে কিনতে ভুলে যায় পৃথিবীর সবকিছুর যোগ্য সে নয়। জনাব রায়নুল ফোনের পর ফোন করতে থাকে। রাগে দুঃখে অপমানে ফোন বন্ধ করে রাখি কয়েক ঘণ্টা। ফোন খোলামাত্রই আবার জনাব রায়নুলের ফোন আসতে থাকে। এই পর্যায়ে আমি ভাবতে থাকি আমার এই বিষয়টিকে এখন ড্রিল করা দরকার। কিভাবে? তা জানি না। তবে এর মুখোমুখি হওয়া দরকার। কিন্তু আমি তখনও ভঙ্গুর, মানসিক শক্তির রিখটার স্কেলে মাপলে জিরো আসবে। তারপরেও শুনতে চাই জনাব রায়নুলের বক্তব্য। এত বড় ঘটনা ঘটানোর পরও কি চায় সে? কি বাকি আছে তার? একটা প্রবাসী মেয়ে, কষ্ট করে কিছু টাকা উপার্জন করে বাঁচিয়েছে, নিজের নাড়ির টানে দেশের মাটিকে ভালোবেসে, মায়ের কথা রাখতে বিদেশে কিছু না কিনে, নিজ দেশে বিনিয়োগ করল; আর তোরা, এতই লোভ তোদের এই মানুষগুলোর পিঠে ছুরি ঢুকসা নিজেদের আভিজাত্য ও বিলাস জীবন-যাপনের জন্য। আর এসব পাপের অর্থ দিয়ে তোরা তোদের সন্তানদের লালন-পালন করিস বিদেশে রেখে। মানুষের রক্ত দিয়ে তোরা খাবার খাস, তোদের বমি আসে না? মরার পর কোথায় নিয়ে যাবি এই টাকা? যখন সবকিছু লুটপাট করা শেষ তখন শেষ যে অবলম্বন থাকে মানুষের ইজ্জত, সেই ইজ্জতের ওপর শেষ ছোবলটুকু তোরা দেস। তোদের খিদা মেটে না।ফোন ধরলাম জনাব রায়নুলের। অপর পাশ থেকে সে বলে উঠল, আপনি তো আইলেন না, কারো কাছে যদি মুখ খোলেন, আপনারে ফেলাইতে আমার দুই সেকেন্ডের ব্যাপার, আয়ারল্যান্ড কিন্তু বেশি দূরে না, বোঝলেন?শব্দগুলো আমার মস্তিষ্কে ট্যাং ট্যাং করে বাজছে। মনে হচ্ছে কেউ মনে হয় আমার রগগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে দিচ্ছে। অনুভব করলাম, আমার হৃদয়ের কম্পন থেমে থেমে হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানেন? ভয় হচ্ছে, আমার সন্তানদের জন্য। ওদের কি হবে? ওদেরকে কীভাবে আয়ারল্যান্ডে নিরাপদভাবে ফেরত নিয়ে যাব?আমি শুধু একটা লাইনই জনাব রায়নুলকে বলেছিলাম, ‘চিন্তা করেন না, কেউ কোনোদিন কিছু জানবে না।’আমি হন্যে হয়ে গেলাম টিকিটের টাকার জন্য এবং আয়ারল্যান্ডে যে বাড়ি ভাড়া জমা পড়েছে তা ব্যবস্থা করার জন্য। কে আমাকে লম্বা সময়ের জন্য ধার দিবে? দেশে যারা আমার কাছের মানুষ তারা আমার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি জানে। বুঝতে পেরেছে খুব তাড়াতাড়ি হয়তো ধার ফেরত আসবে না। আমিও পড়তে পেরেছি তাদের মানসিকতা, কষ্ট পাইনি। মনে হচ্ছিল আমি আগে থেকেই জানি যে উত্তরটা ‘না’ সূচক আসবে। একজন বলে দেখি, পরের দিন আবার ‘না’ বলে। এভাবে সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে। কিছু টাকা ম্যানেজ হয়েছে আর কিছু না পারতে যোগাযোগ করলাম আয়ারল্যান্ডের এক ফটোগ্রাফারের সাথে। যার কয়েকটি শুট আমি করেছি। তার থেকে আমি ধার চাইলাম। সে ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে দিল, আর আমি টিকিট কাটলাম আমাদের জন্য।(চলবে)
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া