একটি রিকশায় দুজন আরোহী যাচ্ছেন সাতমসজিদ রোড দিয়ে। একজন আফতাব আহমাদ, গণকণ্ঠ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। মুজিব সরকার ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৫ পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। অন্যজন মিয়া মুশতাক আহমদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেকচারার (অনেক পরে সরকারের সচিব হয়ে অবসরে যান)। দুজনেই জাসদ-ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাঁরা চেনামুখ।
রিকশাটা ঈদগাহ পেরিয়ে বিডিআর গেটের দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ একটা জিপ এসে পথ আটকাল। জিপ থেকে লাফিয়ে নামল কয়েকজন সশস্ত্র তরুণ। ঘিরে ধরল রিকশা। সবার সামনে সরদারগোছের ব্যক্তিটি হচ্ছেন শেখ কামাল। তাঁকে কে না চেনে! তিনি সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে, দেশের অঘোষিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে দলেবলে সর্বহারা পার্টির পিকেটার ধরতে গিয়ে মতিঝিলে সেমসাইডে পড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন।
আফতাবকে কামাল কিছুক্ষণ বকাঝকা করলেন। মুশতাককে বললেন, ‘আপনি চাটগাঁতে মাস্টারি করেন, ঢাকায় কী কাজ? আপনাদের পুলিশে দেব।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এল। তখন ঢাকার এসপি খুবই করিতকর্মা। ক্ষমতা আইজিপির চেয়েও বেশি। তিনি দুজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেন। দেশে তখন জরুরি অবস্থা।
দুই.
ফ্ল্যাশব্যাক। দেশে চলছে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ থেকে এনএসএফ আর পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন বেরিয়ে গেছে। ছাত্রলীগ আর মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৬৯) যৌথভাবে শিক্ষা দিবস পালন করবে। এ উপলক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যানটিনে ডাকা হয়েছে ছাত্রলীগের কর্মিসভা। সমাবেশ বড় হওয়ায় ক্যানটিনের ভেতরে জায়গা হচ্ছে না। সভা শুরু হলো ক্যানটিনের পাশে সবুজ ঘাসের জমিনে। নেতারা ভাষণ দিচ্ছেন। হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জয় বাংলা’। অল্প কয়েকজন সাড়া দিলেন। এ স্লোগান আগে কেউ শোনেননি। সবাই বিস্মিত। এই তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের (পরে সূর্য সেন হল) ছাত্রলীগ নেতা আফতাব আহমাদ। স্লোগানটি কলাভবনে চাউর হয়। ছাত্রলীগের অনেকেই সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের শিষ্য। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ নিয়ে ক্যাম্পাসে মুখর হন।
তিন.
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। প্রতি রোববার পল্টন ময়দানে জনসভা হয়। ১১ জানুয়ারি ছিল আওয়ামী লীগের জনসভা। মাঠ লোকে লোকারণ্য। মঞ্চে সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতারা বসে আছেন।
সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবের আস্থাভাজন সংগঠক। কয় দিন আগে তিনি গিয়েছিলেন জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে (পরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকীর একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিসে। সেখানে কাজ করেন শিল্পী কামাল আহমদ (কিছুদিন আগে টরন্টোতে মারা গেছেন)। সিরাজুল আলম খানের অনুরোধে কামাল আহমদ দুটো কাঠের টুকরায় এঁকে দেন—জয় বাংলা। সিরাজ এটি পল্টনে সভামঞ্চে পেরেক ঠুকে এমনভাবে লাগিয়ে দেন, যেন মাঠের সব জায়গা থেকে দেখা যায়।
সভা শুরুর আগে শেখ মুজিব সিরাজকে বললেন, ‘স্লোগান দে।’ তিনি দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন ধরে কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে বললেন, জয় বাংলা। সমাবেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর শিষ্যরা সমস্বরে বললেন, জয় বাংলা। এই প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় উচ্চারিত হলো জয় বাংলা।