'৩৬ জুলাই: নির্ভীকদের অভিবাদন' শীর্ষক চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পেরে আমরা গর্বিত বোধ করছি। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা ছাত্র-জনতার প্রতি বিশেষ সম্মান জানাচ্ছি, যারা আমাদের ফ্যাসিবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ সব শহীদদের অভিবাদন জানাই, যারা শোষণের অবসান ঘটাতে প্রাণ দিয়েছেন। যারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন, মানসিক আঘাত পেয়েছেন এবং যারা পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও নিকটজনদের হারিয়েছেন, সবার সঙ্গে আমরা সহমর্মিতা-একাত্মতা প্রকাশ করছি।
এই প্রদর্শনীটি ডেইলি স্টার সেন্টারে আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। ডেইলি স্টার কীভাবে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের সংবাদ প্রকাশ করেছে, সেসময় আমাদের সম্পাদকীয় নীতি, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লেখা প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হবে। এই প্রদর্শনীতে আমরা দেখাব কীভাবে আমাদের সাংবাদিকরা, বিশেষত আলোকচিত্রীরা জীবনঝুঁকি নিয়ে দেশ ও বিশ্বের পাঠকের কাছে শিক্ষার্থী ও স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও বীরত্বের গল্পগুলো তুলে ধরেছেন। আমরা গর্বের সঙ্গে বলছি, আন্দোলনের পুরো সময়টা শিক্ষার্থী ও জনমানুষের পাশেই ছিলাম এবং সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা হয়েছে, আমাদের সক্ষমতা ও প্রতিভার পূর্ণ ব্যবহার করে তার সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি।
এই প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হবে 'জুলাইয়ের ৩৬ দিনের' ঘটনাপ্রবাহ আমরা কতটা আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিবেশন করেছি। যত দিন যাচ্ছিল শাসকগোষ্ঠী আরও নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়ে উঠছিল। আমরা ঘটনার গভীরে গিয়ে তুলে ধরেছি সেসব বর্বরতার চিত্র।
জনসমর্থন নিয়ে ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছেন। উন্মোচন করেছেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অধিকার ও সম্ভাবনার নতুন দ্বার। আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে নতুন বাস্তবতা ও সম্ভাবনা। নতুন বাংলাদেশ সত্য-সাহস, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের আশা ও বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম সফলভাবে গণতন্ত্র গড়ে তুলবে এবং একটি অধিকারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে বৈষম্য, অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার আর থাকবে না। বিষয়টি কিছুটা ভাববাদী মনে হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা সবাই একমত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাত্র-জনতার বিপ্লবের এই অর্জনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। তারা তাদের ইচ্ছা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং চরমপন্থা অবলম্বন করে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে, যা বিপ্লবের অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। এসব বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা ও বিভাজন সৃষ্টির প্রচেষ্টার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্রনেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছি। ঘৃণা ও মিথ্যা বয়ান ছড়িয়ে তারা সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং এর মাধ্যমে ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক শক্তির বিপরীতমুখী অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠীগুলো নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আকাশ কালো মেঘে ঢেকে দিচ্ছে।
আমরা মনে করি সাম্প্রতিক সময়ে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে লক্ষ্য করে যে আক্রমণগুলো হয়েছে, তা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। দেশের শীর্ষ দুই পত্রিকাকে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করতে চরম মিথ্যা বয়ান, মতবাদ চাপানোর প্রচেষ্টা, উগ্রবাদী আচরণের প্রবণতা এবং কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে, তা যেমন শুধু ছাত্রদের বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট ঐক্য ও উদ্দীপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তেমনি সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও বাধাগ্রস্ত করবে।
আসুন আমরা নতুন এই বাংলাদেশে আমাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করি, ভিন্নমত নিয়ে গঠনমূলক বিতর্ক করি এবং আমাদের নিজ নিজ দর্শন, আদর্শ, ও তথ্যভিত্তিক ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করি, যেন সবাই মিলে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এই লক্ষ্য নিয়েই দ্য ডেইলি স্টারে আমরা কাজ করছি এবং এটাই আমাদের সাংবাদিকতার সংজ্ঞা।
এই মুহূর্তে আমরা সমালোচনার মুখে আছি। দাবি করা হচ্ছে, আমরা পক্ষপাতদুষ্ট। আমরা এ ধরনের সমালোচনা ও সমালোচকদের স্বাগত জানাই। আমরা প্রকৃতপক্ষেই তাদের কথা শুনতে চাই এবং তাদের কাছ থেকে জানতে চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমালোচনা যদি তথ্য, যথাযথ বিশ্লেষণ ও সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে হয়, তবে তা সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন এবং জাতিকে আলোকিত করে। আর যদি তা না হয়, তাহলে জনগণ ভুল পথে পরিচালিত হয়, পাঠক-শ্রোতারা ভুল তথ্য পায়, সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়ায়।