ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে যে আশাজাগানিয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটা কতটা ধরে রাখতে পেরেছে, সে প্রশ্ন উঠেছে। আগে রাস্তাঘাটে সভা–সমাবেশে কারও সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, যাক, স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশটা রক্ষা পেল। তাঁদের কণ্ঠে একধরনের স্বস্তি ও তৃপ্তি লক্ষ করতাম। এখন জিজ্ঞেস করেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না কেন, দেশে হচ্ছেটা কী?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানা রকম প্রস্তাব আসছে। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনগুলোও কাজ শুরু করেছে। এসব নিশ্চয়ই আশার দিক। কিন্তু হতাশার খবর হলো, সরকার জনজীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অবনতিশীল। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটছে।
অতি সম্প্রতি তিন কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ ও চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণী জোটের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন না হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য। এর আগে ছাত্ররা আগাম ঘোষণা দিয়ে পালন করলেন ‘সুপার সানডে’ ও ‘মেগা মানডে’। কর্মসূচির নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে গেল সবকিছু শেষ হওয়ার পর। আর চট্টগামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ঘটনায় যে ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে, সেটা ছিল অপ্রতুল। এ কারণে চিন্ময় অনুসারীরা একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারল।
অতীতে নিম্ন আদালতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজবীদের মধ্যে হট্টগোলের কথাও আমরা জানি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারকের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা এই প্রথম।
বুধবার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে (বিজয় ৭১ ভবনের ৩২ নম্বর আদালত) যা ঘটেছে, তা অবিশ্বাস্য। ৮ বছর আগে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ–সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ে তিন বিচারকের একজন ছিলেন বিচারপতি আশরাফুল কামাল। আর এ রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন—এমন অভিযোগ করে কয়েকজন আইনজীবী প্রথমে তাঁর উদ্দেশে কিছু মন্তব্য করেন। এরপর একজন আইনজীবী তাঁর দিকে ডিম ছুড়ে মারেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে ছুড়ে মারা ডিম বিচারপতির গায়ে লাগেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হইচই, হট্টগোলের মধ্যে বিচারপতি আশরাফুল কামাল ও বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলাম এজলাস ত্যাগ করেন।
উচ্চ আদালত হচ্ছেন মানুষের শেষ ভরসা। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আটকে রাখা যায়নি, তার অন্যতম কারণ উচ্চ আদালতের ন্যায়বিচার।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত হয়। পরে এ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রুল যথাযথ ঘোষণা করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ বলে রায় দেন।
আসাদুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ শীর্ষক এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি আশরাফুল কামাল বাংলায় দেওয়া তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকবাকুম করে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন, তথা রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একবারও ভাবলেন না, তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে তিনি আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন। ভাবলেন না তাঁর শপথের কথা। ভাবলেন না তিনি দেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করার শপথ নিয়েছিলেন।’ তিনি আরও কিছু মন্তব্য করেছেন, যা একজন বিচারক হিসেবে করতে পারেন কি না, সেই প্রশ্ন আছে।