বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আবারও উত্তাল। ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে শুধু বুয়েট প্রাঙ্গণই নয়, গোটা দেশ, পত্রপত্রিকা, স্যাটেলাইট চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া মুখর। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে বহু যুক্তিতর্ক কয়েক দিন ধরে চলছে। চার বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আবরারকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিরাপত্তার তীব্র দাবিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ। সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে এই হত্যাকাণ্ড যতটা না মুখ্য হয়ে উঠেছিল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছিল নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে। শুধু এ ঘটনা নয়, বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংগঠন দ্বারা যে ধরনের অমানবিক, নৃশংস ও বিশৃঙ্খলাজনিত ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে অহরহ, তা দেখে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ছাত্ররাজনীতির প্রতি তাঁদের আগ্রহ, উৎসাহ হারিয়েছেন। উপরন্তু, কোনো কোনো ছাত্রসংগঠন তাদের কাছে রীতিমতো ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব অযৌক্তিক নয় ব্যাপারটা। যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে, যদি ছাত্রসংগঠনগুলোর ভালো ও মন্দ কাজের তালিকা তৈরি করে তা বিশ্লেষণ করা যায়। স্পষ্ট হয়ে উঠবে আতঙ্কের পেছনের কারণগুলো।
অনেকেই ভেবে থাকেন যে, বুয়েটে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আবার অনেকের এমনও ধারণা আছে, যে দেশে উচ্চতর বিদ্যাপীঠে ভর্তি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতি ধরা পড়ে এবং তা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটা ঐতিহ্যের পর্যায়ে পৌঁছায়, এমনকি বিসিএস পরীক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের কথা শোনা যায় প্রায়ই, সেই দেশে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা সবাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও শৃঙ্খলায় পড়াশোনার সমান সুযোগ পাবেন বুয়েটে, তা কি সম্ভব? ব্যতিক্রম কি নেই বিশেষ কারোর জন্য, গোষ্ঠীর জন্য? ক্ষমতা ও প্রভাব যাঁদের, তাঁরাই তো সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকেন। এই দ্বিতীয় ধারণার জবাব অবশ্য বুয়েট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারে।
যা হোক, আবরার নির্মমভাবে খুন হন। এতে তাঁর মায়ের বুক খালি হয়। শুধু কি তাই? মোটেও না। আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তাঁদেরও কি মেরে ফেলা হলো না? হলো তো! যাকে হত্যা করা হয়েছে এবং যারা হত্যা করেছে, এদের সবার অভিভাবকদের চোখের পানির কিন্তু কোনো ভিন্নতা নেই। সবাই স্বজন হারিয়েছেন অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে। এই অভিভাবকগণ কিন্তু তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েটে একজন প্রকৌশলী মানিক পাওয়ার আশায়। যা পেলেন বা পান, তা তাঁদের স্বপ্নভঙ্গের মতো, নিষ্ঠুর ও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাঁরা যে সন্তানদের পাঠান, সেই সন্তান আর ফিরে পান না। এটাই আমাদের প্রচলিত রাজনীতির করুণ পরিণতি!
কেউ কেউ বলছেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ঘোষণায় ছাত্রশিবির সংগঠনের তৎপরতা দেখা দিয়েছে। আচ্ছা, শিবির কি ছাত্রসংগঠন নয়? ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে এই সংগঠন বুয়েটে তৎপরতা চালায় কী করে? নাকি তারা বোঝাতে চাইছেন যে, বুয়েটে ছাত্রলীগ সক্রিয় না থাকায় পাকিস্তানি গোষ্ঠী বা শিবির সংগঠন উঠে দাঁড়িয়েছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক—যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরেও অন্য রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন, যেমন—শিবির বা পাকিস্তানি গোষ্ঠী তৎপর হয় কী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত এত বুঝদার ও সক্ষম বুয়েট প্রশাসন থাকতে? বুয়েট প্রশাসন কী করছে তাহলে? নাকি একটা ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা তাদের নেই? বুয়েট প্রশাসন ব্যর্থ তার প্রাঙ্গণে শিবির বা জঙ্গি সংগঠনকে নিবৃত্ত করতে। আর সে কারণেই কি বুয়েট কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করছে, তাদের এই চরম ব্যর্থতার গ্লানি ও লজ্জা মুছে দিতে পারে কেবল ছাত্রলীগ? সাধারণ জনগণ কিন্তু তেমনটাই ভাবতে শুরু করেছে।