ছোটবেলাতেই বাবাকে হারানো সুমি আক্তারকে (ছদ্মনাম) মা ও ভাইয়েরা বিয়ে দেন একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর মাদকাসক্তের বিষয়টি বুঝতে পারেন সুমি। বিয়ের মাস তিনেক পর থেকেই প্রতিদিনই চলতে থাকে সুমির ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নেশা করে বাসায় ফিরে সুমির সঙ্গে চেঁচামেচি ও ভাঙচুর নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ আটটি বছর। সুমির চার ও পাঁচ বছরের ফুটফুটে দুই ছেলেসন্তান রয়েছে। বাবার অস্বাভাবিক আচরণের প্রভাব পড়ছে তাদের ওপর। বিয়ের পর থেকে সুমি এখন পর্যন্ত ছয়টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়েছেন স্বামীকে। প্রতিবারই বাসায় ফিরে কিছুদিন ভালো থাকার পর ফের নেশার জগতে বুঁদ হয়েছেন। এখনো রাজধানীর একটি সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছেন সুমির স্বামী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সুমির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না। নির্যাতনের কারণে কোনো ভাবেই স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সে যে বেতন পায় সব নেশা করে শেষ করে ফেলে। বাসার মধ্যেই নেশা করা শুরু করে। কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তোলে। তার (স্বামী) মা, ভাই ও বোনেরাও চেষ্টা করছে সুস্থ করতে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আমার বাবা নেই, ফলে দুই ছেলে নিয়ে বাবার বাড়িতেও যেতে পারছি না। কে আমাকে সাহায্য করবে। কোথায় গেলে আমি মুক্তি পাব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন করব। কিন্তু আমার আবেদনে কি সাড়া দেবেন তিনি? এসব কথা বলার সময় চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল সুমির।
এতো একটি পরিবারের মাদকের ছোবলের চিত্র। এমন চিত্র দেশের হাজার হাজার মাদকাসক্তদের ঘরে ঘরে। গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি মাদকাসক্ত। এদের অনেকে চিকিৎসা নিয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। আবার দেশে পর্যাপ্ত নিরাময় কেন্দ্রে না থাকায় অনেকে চাইলেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। দেশে নেই পর্যাপ্ত সাইক্রিয়াটিস্টও।
মুন্সীগঞ্জের সিপাহিপাড়া থেকে মো. হৃদয় মাতবর এসেছেন তার বাবা সালাউদ্দিন মাতবরকে (৫৫) দেখতে। তিনি কেন্দ্রীয় মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি আছেন। হৃদয় দেশ রূপান্তরকে জানান, গত সাত বছর ধরে তার বাবা হেরোইন, ইয়াবা ট্যাবলেট ও ঘুমের ওষুধ খান। অটোগাড়ি চালিয়ে যা আয় করেন সব নেশা করে শেষ করেন। এছাড়া সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, ঘরে ভাঙচুরও করেন। এর আগেও তিন বার বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রে রেখেছিলেন। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। নিরুপায় হয়ে সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে এনেছেন। তবে এখানে ২৮ দিনের বেশি রাখতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে। হৃদয় মাতবর বাবাকে আরও কিছুদিন এ নিরাময় কেন্দ্রে রাখার জন্য চেষ্টা করছেন।