মহান মে দিবসে রক্তের বিনিময়ে শ্রমিকের অধিকারের জয় হয়েছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকরা এবং মধ্যবিত্ত সচেতন মানুষ এই দিনটিকে পালন করে আসছে বহুদিন ধরেই। এই দিনটি পালনের প্রধান ফলাফল হচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার কিছু কিছু দেশে মে দিবসের যা কিছু অর্জন তার ছিটেফোঁটাও অর্জিত হয়নি আজ অবধি। বাংলাদেশ যেহেতু আইএলও কনভেনশনের আনুগত্য স্বীকার করেছে তাই এখানে কিছু কিছু বিষয় বাধ্যতামূলক হলেও বিস্তর বিষয় এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটা অভূতপূর্ব বিষয় ঘটে গেছে তা হলো কোনো কোনো জায়গায় মালিক ও শ্রমিক একাকার হয়ে গেছে। যেখানে একাকার হয়ে গেছে সেখানে শ্রমিকের অধিকার সম্পূর্র্ণভাবে দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল। মালিকের পেটুয়া বাহিনীর কাছে শ্রমিকরা সবসময়ই ভীতসন্ত্রস্ত। সবচেয়ে নৈরাজ্যের জায়গা হচ্ছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কর্মরত আছে। গত করোনাকালে শ্রমিকদের অসহায় অবস্থা আমরা দেখেছি এবং বেদনাহত হয়েছি। যেহেতু গার্মেন্টস সম্পূর্ণভাবে একটি রপ্তানিযোগ্য ব্যবসা, তাই উন্নত দেশের আমদানিকারকরা কিছু বিধিনিষেধ দিয়ে থাকে এবং সেগুলো মেনে চলতে হয়। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে এসব মানা-না মানা সম্পূর্ণ মালিকদের ওপর নির্ভর করে।
আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি প্রায় অনুপস্থিত। রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলো প্রায়ই বন্ধ, আদমজীর মতো এত বড় জুটমিল বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে। বিপুল বেকারত্ব, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে ঘাটতিসহ নানা অমানবিক পরিস্থিতির মধ্য শ্রমিকশ্রেণি নিপতিত হয়েছে। খুলনার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জুটমিলগুলো বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের চাকরির নিশ্চয়তা দিত এবং বিদেশে রপ্তানির বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছিল। সেসব এখন অতীত। দায়িত্বহীন ব্যবস্থাপনা, শাসকগোষ্ঠীর লুটপাট এবং খাঁটি শ্রমিকদের বঞ্চনা সবটা মিলিয়ে একটা অসহায় রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ওপর দায় চাপানো মালিক পক্ষের একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছিল এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলো পানির দামে ক্রয় করে কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এসব বিষয় সবারই জানা। তবে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখানে অবতারণা করতে চাই তা হলো শ্রমিকশ্রেণির সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে শ্রমিকের আচরণ তার কর্মদক্ষতা, নিরাপদ জীবনযাপন, পারিবারিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম। এসব কিছুর মূলে আছে শিক্ষা।
একটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানার পরিবেশে। এসব কলকারখানার পাশে স্কুল তৈরি করা হতো, যেখানে শ্রমিকদের সন্তানরা পড়ালেখা করতে পারত। শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নিজেদের অধিকার সচেতন করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করত। সাধারণত রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলতে বামপন্থি ও কমিউনিস্টদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে দেখা যেত। সেই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, গায়ক, চিত্রকর এরা শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত। সেখান থেকে অনেক কালজয়ী উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র, সংগীত এবং চিত্রকলার জন্ম হয়েছে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ১৯৪২ সালে একটা বিশাল ভূমিকা পালন করেছে, যার ফলে উপমহাদেশজুড়ে একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি সেই সংস্কৃতিকে দীর্ঘদিন এগিয়ে নিয়ে গেছে। সংস্কৃতিকে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। নির্বাচনী প্রচারণায় এক সময় নাটক ও সংগীতের দলগুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কৃতির আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে। আমাদের দেশেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সংস্কৃতির আহ্বানে রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামত, তারপর কখনো সংস্কৃতি ও রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলত। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে যে সম্মেলন হয়েছিল তার মূলে ছিল সংস্কৃতি। টাঙ্গাইল থেকে কাগমারি পর্যন্ত অনেক তোরণ নির্মিত হয়েছিল, সেই তোরণগুলোর নামকরণ হয়েছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের নামে। যেমন- বায়রন তোরণ, শেলী তোরণ, শেক্সপিয়ার তোরণ, জালাল উদ্দিন রুমী তোরণ-এর মধ্যে অবশ্য লেনিন তোরণও ছিল। অতিথি হিসেবে পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছিলেন তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু প্রমুখ। একজন নৃত্যশিল্পী এসেছিলেন মিসর থেকে। দেশের গায়ক-গায়িকারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলাসহ আরও নানা ধরনের লোকসংস্কৃতির প্রদর্শনী হয়েছিল। রাজনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল সেই সময়।