শেখ মুজিবের সাহস তো অবশ্যই, বুদ্ধিমত্তাও ছিল প্রখর

ডেইলি স্টার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১০:০৭

শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের লোকদেরও কেউ কেউ তার অবস্থানের প্রতি নমনীয় ছিলেন। যে জন্য গণহত্যা শুরুর আগে পূর্ববঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্তব্যরত সাহাবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগ করেন; এবং নৌবাহিনীর এস এম হাসানকে সরিয়ে দিয়ে টিক্কা খানকে গভর্নর ও সামরিক শাসক হিসেবে আনা নয়। টিক্কা খান 'বেলুচিস্তানের কসাই' উপাধি পেয়েছিলেন; যে-উপাধির তিনি অযোগ্য ছিলেন না এবং পূর্ববঙ্গেও তিনি এসেছিলেন 'কসাই' হিসেবেই। এই পাঞ্জাবি সেনাধ্যক্ষ উঠে এসেছিলেন একেবারে সিপাহির স্তর থেকে, এবং সেনাবাহিনীতে ঢোকার সময় মেট্রিক পাস ছিলেন কি না সন্দেহ; পরাজয়ের আগেভাগে তিনি পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেন, এবং তার 'দক্ষতার' বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তাকে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ দেন। ভুট্টো শেষ পর্যন্ত নিহত হলেন জুলুমবাজ ওই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতেই। তিনি ঘোরতর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, তার হত্যাকারীরাও ওই একই ঘরানার লোক, কিন্তু তাদের মনে হয়েছিল পাকিস্তানের খণ্ডিতকরণের জন্য ভুট্টোও কম দায়ী নন; এবং তার হাতে রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত 'ইসলামী' চরিত্রটা সুরক্ষিত থাকবে না। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া দরকার।


শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য সাফল্যের পেছনে তার ব্যক্তিগত বিভূতি কার্যকর ছিল। সাহস তো অবশ্যই, তার বুদ্ধিমত্তাও ছিল প্রখর। কখন কোন আওয়াজটা তুলতে হবে, তুললে মানুষ সাড়া দেবে সেটা তিনি জানতেন। আপস করতেন না। মানুষ চিনবার ক্ষমতা তার ছিল অতুলনীয়। ছাত্র ও যুবকদেরকে তিনি যে অমনভাবে কাছে টেনে নিতে পারতেন তার কারণ ছিল নেতৃত্বদানে তার ক্ষমতা। কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে সেটা তিনি বুঝতেন। আগরতলা মামলার সময়ে তার মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন করছে সেটা তার অজানা থাকবার কথা নয়; কিন্তু তিনি জানতেন এ আন্দোলনকে পূর্ণতা দেবার জন্য একজনকে খুব দরকার, তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। সামরিক আদালত থেকে সাংবাদিক আতাউস সামাদের মারফত মওলানার কাছে তিনি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার মুক্তির জন্য আন্দোলনের অনুরোধ জানিয়ে। সংক্ষিপ্ত বার্তাটিতে তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তাকে মওলানার দরকার হবে, এবং তারও দরকার হবে মওলানাকে। মওলানা বুঝি এই রকমের একটি বার্তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি ঘোষণা দেন যে ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টনে জনসভা হবে, মুজিবের মুক্তির দাবিতে। সেই জনসভাতে মওলানা যে অনলবর্ষী বক্তৃতা দেন তাতে মানুষ যেমন উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তেমনি ভয় পেয়ে যায় শাসকেরা। তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে, জেলের তালা ভাঙা হবে, ব্যাস্টিলের দুর্গের মতন পতন ঘটবে সামরিক কারাগারের। সমাবেশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী আওয়াজ উঠেছিল 'জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।' এরপর অবশ্যম্ভাবী ছিল যে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হবে, এবং মামলার সকল অভিযুক্ত তো বটেই অন্যান্য রাজবন্দিরাও মুক্তি পাবেন। 


গণহত্যা শুরুর আগে একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান আসগার খান দেখা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দাবিকে তিনি অযৌক্তিক মনে করতেন না। তার উদ্বেগ ছিল পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে এবং টের পাচ্ছিলেন যে পীড়ন করলে পাকিস্তান টিকবে না। গভীর দুঃখের সঙ্গে শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের কখনো বিশ্বাস করেনি, তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হয়নি। আসগার খান বিস্মিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবের দূরদৃষ্টি দেখে। শেখ সাহেব তাকে বলেছিলেন তিনি নিশ্চিত যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছেন। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তান চিরকালের জন্য দাবিয়ে দেওয়া। আগামীতে কী কী ঘটতে যাচ্ছে তারও একটা ছবি দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। বলেছিলেন প্রথমে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন, অল্প পরেই আসবেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এম এম আহমদ; তারপরে ভুট্টো। এরপরে ইয়াহিয়া খান সামরিক পদক্ষেপ নেবেন, এবং তাতে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে। সেসব ঘটনাই ঘটেছে; এবং ওই অনুক্রমেই।


নিজের সম্বন্ধে মুজিব বলেছিলেন যে, তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হবে; আর সেটা যদি না ঘটে তাহলে তিনি নিহত হবেন হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, নয়তো তার নিজের লোকদের দ্বারা। আসগার খান এসব কথা লিখেছেন তার 'জেনারেলস ইন পলিটিকস ১৯৫৮-১৯৮২' নামের বইতে। উল্লেখ্য, মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের সময়ে একদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্টের ভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে একান্তে ডেকে নিয়ে ভুট্টোকে মুজিব এই বলে সতর্ক করে দেন যে, সেনাবাহিনী আগে তাকে (মুজিবকে) হত্যা করবে, তারপর ভুট্টোকে। ভুট্টো সেই সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করেননি; তার মাথায় তখন খেলা করছে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আরোহণের স্বপ্ন। অথচ মুজিব যা বলেছিলেন সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সেটাই। তারা মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল; পারেনি; পরে ভুট্টোকে হত্যা করতে চেয়েছে, পেরেছে। মুজিবের সতর্কবাণীর কথা ভুট্টো নিজেই বলেছেন, তার 'দি গ্রেট ট্রাজেডি' বইতে। সেটা লেখা হয়েছিল ওই একাত্তর সালেই, আগস্টের দিকে। দৃষ্টির এই প্রখরতা না থাকলে মুজিব অত বড় নেতা হলেন কী করে, সমসাময়িক ও সমবয়স্ক সবাইকে ছাড়িয়ে? সঙ্গে ছিল অতুলনীয় সাহস। জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে, তবু সাহস হারাননি। প্রাণসংশয় যখন দেখা দিয়েছে তখনও অবিচলিত থেকেছেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us