বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল বলেছিলেন, গল্পের চেয়েও সত্য ঘটনা অনেক বিস্ময়কর হতে পারে। তেমনই এক বিস্ময়কর ও নিষ্ঠুরতম সত্য ঘটনায় গোটা দেশ হতবাক হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার রাতে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ‘ঈগল এক্সপ্রেস’ বাসে যে ডাকাতির ঘটনা ঘটল, তা কোনোভাবেই ভোলার মতো নয়। কোনো নিছক বাস ডাকাতি ছিল না সেটি। ডাকাতেরা যাত্রীদের বেঁধে রেখে ও মারধর করে টাকা, স্বর্ণালংকারসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এক ভয়াবহ ও নিষ্ঠুরতম কাণ্ডও ঘটিয়েছে। বাসভর্তি মানুষের ভেতরে ছয়জন ডাকাত একের পর এক ধর্ষণ করে গেছে এক তরুণী যাত্রীকে। ডাকাতি করার সময় ওই তরুণী প্রতিবাদ করেছিলেন, আর এর বিনিময়ে এমন ‘শাস্তি’ দিল তাঁকে ডাকাতেরা। ধর্ষণের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে একপর্যায়ে ওই তরুণীর হাত ও চোখের বাঁধন পর্যন্ত খুলে যায়। গত বৃহস্পতিবার আদালতে ওই নারী জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়েছেন। বাসের অন্যান্য যাত্রীর ভাষ্যেও উঠে এসেছে সেই রাতের লোমহর্ষক ঘটনা। শুধু তাঁকে নয়, আরও এক নারীকেও নির্যাতন করা হয়। চিকিৎসকেরা ওই তরুণীকে ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন।
মাঝরাস্তায় যাত্রীবেশে কয়েক দফায় ডাকাতেরা ওই গাড়িতে ওঠে। সংখ্যায় তারা ছিল ১০-১২ জন। একপর্যায়ে গোটা বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাত দল। ডাকাতি শুরুর আগে সবার মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে যাত্রীরা ৯৯৯ নম্বরেও ফোন করতে পারেননি। এক যাত্রী সেই চেষ্টা করলে তাকে ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করা হয়। ডাকাতেরা এমন আতঙ্ক তৈরি করে যে বাসের ভেতরে থাকা শিশুরা কেঁদে উঠেছিল। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ইচ্ছেমতো গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন করে তিন ঘণ্টা ধরে কী ‘নির্ভীকভাবে’ এমন অরাজকতা চালিয়ে গেল ডাকাতেরা। কত গাড়ি ওই বাসের আশপাশ দিয়ে চলল, কেউ বুঝল না। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেই দীর্ঘ সময় ধরে হাইওয়ে পুলিশের কোনো টহলও ওই এলাকায় দেখা যায়নি।
এ জন্যই কি ইতিহাসবিদ ও লেখক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৮৩-১৯৬৫) তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙলার ডাকাত’ বইয়ে এমন মন্তব্য করেছেন—‘দেশে শাসন নাই, কেউ কাহাকেও দেখে না, দস্যুদল নির্ভীকভাবে ডাকাতি করে।’ চার খণ্ডে প্রকাশিত বইটিতে ইংরেজ আমলে বাংলা অঞ্চলের ডাকাতির ইতিহাস তুলে এনেছিলেন তিনি। সে সময় নবাবেরা ছিলেন নামেমাত্র শাসক, তাঁদের ক্ষমতা ও শৌর্যবীর্য ক্ষয়িষ্ণু। ফলে ডাকাতদের চরম নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর তখনকার বাংলা অঞ্চল মানে নদ-নদী ও বন–জঙ্গলে পরিবেষ্টিত ডাকাতির এক ‘স্বর্গভূমি’। নবাবের পাইক–পেয়াদা বা ইংরেজের পুলিশ ডাকাতদের টিকিটি খুঁজে পেত না।
সেই ইংরেজের কাল ফুরিয়েছে দুই শ বছর আগে। দুই দফা দেশ স্বাধীন হয়ে আজকের বাংলাদেশের নাগরিক আমরা। সেই আমলের নদ-নদী বা ঘন বন-জঙ্গলও এখন আর নেই। তবে ডাকাতি ঠিকই থেকে গেছে, তবে তার ‘জৌলুশ’ হারিয়ে গেছে। সে সময় আতঙ্ক মানে ছিল ডাকাত বা দস্যু দল। শিশুদের ঘুম পাড়ানোও হতো ডাকাতের ভয় দেখিয়ে। এখন সেই ভয় আগের মতো নেই, সেটিকে আরও বড় ভয় এসে গিলে খেয়েছে। আগে যারা ডাকাত ধরত, তারাই এখন ডাকাতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন বহুমুখী আতঙ্কের শেষ নেই। এত সামাজিক অনাচার ও অঘটনের কাছে ডাকাতি যেন তুচ্ছ বিষয়। আর তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে বদলে গেছে ডাকাতির চেহারাও। ডিজিটাল দুনিয়ায় ডিজিটাল ডাকাতি! আগের ডাকাতেরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত বা আস্তানা গেড়ে লুকিয়ে থাকত। আর এখনকার ডাকাতেরা ভদ্রবেশী, উপরের তলার মানুষ। ব্যাংক সাফ করে দিয়ে বিদেশে বেগমপাড়া নামক ‘যক্ষপুরীর’ কারিগর বনে যান তাঁরা। ফলে ঘরবাড়ি বা রাস্তাঘাটে ডাকাতির খবর নিয়ে মাথা ঘামানো মানে সাবেকি আমলে পড়ে থাকা, এখনকার আধুনিক মানুষের স্ট্যাটাসের সঙ্গে যায় না!