পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে; কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভূমিকম্প, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যৎই জানে।
আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয়, বিশ্ব একটি মানবিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে ঘরে ঘরে, দেশে দেশে, মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনোই সুন্দর ও শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্রাজ্যবাদসহ সব উগ্রপন্থীকে নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি, একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে; সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমনপীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ড দেখে আজ সংগত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি তাহলে আবার পেছনে ফিরে যাচ্ছি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমি আর নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার আগে ইলাদি বলেন, ‘কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কী হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।’ তবু আমি কল্পনাদির স্নেহের কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, তিনি তার বেডে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি, বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, ‘একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আজ দেখছি, পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।’ তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনো কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এ রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন, সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভূমি থেকে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে উঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক ও জীবাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিকবোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সবাইকে আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের।