বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কর্মচঞ্চল সক্রিয় এক পূর্ণাঙ্গ জীবন শেষে চলে যান ২০২১ সালের ১৬ মার্চ। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে ছাত্রজীবন থেকে মওদুদের ভেতর যে কর্মচাঞ্চল্য, তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কীভাবে উজ্জীবিত রেখেছিলেন, সে এক অপার রহস্য আমাদের অনেকের কাছেই। আমরা যখন আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে অনেকটা ম্রিয়মাণ, মওদুদ নিজেকে রেখেছিলেন উজ্জীবিত। বয়সের ভারে আমরা যখন ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে পরিবারকেই প্রধান আশ্রয় ভাবছি, তখন ওজস্বী মওদুদ তাঁর বুদ্ধিচর্চা, লেখালেখি, রাজনীতি আর দেশভাবনায় খুবই সক্রিয়। মৃত্যুর এক মাস আগেও তেজদীপ্ত ও আবেগপূর্ণ ভাষায় বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন মওদুদ। তাঁর অকস্মাৎ বিদায় বন্ধু, সহযোদ্ধা, অনুসারী আর অনুরাগীদের কাছে এক বেদনার বিষয়। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিতে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে একজন নায়ক বিদায় নিলেন। জীবদ্দশায় যিনি ছিলেন কখনো নিন্দিত, কখনো নন্দিত। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন কী হবে, তা থাকুক আগামী প্রজন্মের হাতেই।
স্কুলজীবনে আগামসিহ লেন আর কায়েতটুলীতে আমরা বেড়ে উঠেছি একসঙ্গে। স্কুলজীবনে পাড়ায় বিভিন্ন নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলায় একসঙ্গে অংশ নিয়েছি। মওদুদ আমার স্কুলজীবন, ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে অত্যন্ত সাহসী আবেগপ্রবণ ও বেপরোয়া ছিলেন। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মওদুদ ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এ কারণে নবকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। নবকুমার থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে বিভিন্ন আন্দোলনে ও কলেজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে ৯২ (ক) ধারাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন। ১৯৫৬ সালে আমরা দুজন একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে মওদুদ ও আমি সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ছাত্ররাজনীতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলাম আমরা।
মওদুদ তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠন ছাত্র শক্তিতে যোগদান করে ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় রাজনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, ছাত্ররাজনীতিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঙ্গনে, হল ইউনিয়ন, ডাকসু নির্বাচনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডে মওদুদ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, যেখানে তাঁর ভূমিকা ছিল না। এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মওদুদ সাধারণ ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।