দিনভর বিক্ষোভ। অবরোধ। দীর্ঘ যানজট। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ি চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার এবং নিরাপদ সড়ক দাবিতে গতকাল এমন পরিস্থিতি ছিল রাজধানীজুড়ে। বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করায় কার্যত অচল হয়ে পড়ে প্রধান প্রধান সড়ক। বিকালে দাবি পূরণে সিটি করপোরেশনের আশ্বাস পাওয়ায় ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি শেষ করেন। নাঈমের মৃত্যুতে দায়ী গাড়ি চালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া কার্যকরসহ বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছেন শিক্ষার্থীরা। গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া নিয়ে সপ্তাহখানেক ধরেই চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন চলাকালেই গত বুধবার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম সিটি করপোরেশনের গাড়ি চাপায় মারা যান। এ ঘটনার পরপরই তার সতীর্থরা রাজপথে নামেন। সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। নাঈমের হত্যার বিচার, অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করাসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বরে দ্বিতীয় দিনের মতো সড়কে নামেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা, ‘আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমরা বিচার চাই’ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, নাঈম হত্যার বিচার চাই’, ‘জাস্টিস ফর নাঈম’-সহ নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বিআরটিএ- এখানে স্বল্প মূল্যে মানুষ মারার লাইসেন্স দেয়া হয়’, ‘পরবর্তী নাঈম কে?’, ‘নক্ষত্রগুলো রাস্তায় পিষুক, গ্রহাণুগুলো শাসন করুক’, ‘কলেজ ড্রেসে রক্ত কেন?’, ‘এদেশের মেধা যায় রাস্তায় পিষে’, ‘এদেশে ১৮ আসুক নেমে’ ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় মতিঝিল এলাকা। এরপর তারা অগ্রসর হন নগর ভবনের দিকে। নগর ভবনের সামনে গিয়ে ফের বিক্ষোভ করেন।সেখানে শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে দেখা করতে চান। তারা স্লোগান দেন ‘মেয়র তোমার দেখা চাই, নাঈম হত্যার বিচার চাই।’ এ সময় তারা ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবির মধ্যে আছে- জেলা শহরের বিভিন্ন রুটে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু করা, স্কুল-কলেজের সামনে হর্ন ও ওভারস্পিডিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের দ্বারা জরিমানা আদায় ও প্রশাসনের কাছে দোষীদের হস্তান্তরের অধিকার দেয়া। সব শিক্ষার্থীর হাফপাস নিশ্চিত করা। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একাধিক স্পিড ব্রেকার নির্মাণ। শহরের প্রতিটি অচল ট্রাফিক লাইটের সংস্কার এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। ট্রাফিক আইনের সঠিক প্রয়োগ। জেব্রা ক্রসিংয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা। চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানামা করালে প্রত্যেক বাসকে আইনের আওতায় আনা। সর্বোপরি নিরাপদ সড়ক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা। নগর ভবনের ফটকে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে ফটকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে স্লোগান দিতে থাকেন। দীর্ঘ বিক্ষোভের পর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে নগর ভবনের মূল ফটকে আসেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে তিনি শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করার কথা জানান। মেয়র বলেন, নাঈম শুধু আপনার ভাই না, বন্ধু না। নাঈম আমারও সন্তান। সন্তানহারা পিতামাতাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তাপস আরও বলেন, ডিএসসিসির নিজস্ব অর্থায়নেই গুলিস্তান মোড়ে নাঈমের নামে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।মেয়রের আশ্বাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নগর ভবনের মূল ফটক ছেড়ে চলে যান। ফলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর নগর ভবনের সামনের রাস্তায় পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়। তারা দাবি পূরণে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। আর বিচার না হলে ফের সড়কে নামার হুঁশিয়ারি দেন।রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় হাফ পাসের ঘোষণা সংবলিত প্রজ্ঞাপনের দাবিতে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। বেঁধে দেয়া সময়ে প্রজ্ঞাপন পাস না হওয়ায় গতকালও সড়কে নামেন তারা। দুপুর একটা থেকে ৪৫ মিনিট তারা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। হাফপাসের সঙ্গে নটর ডেম শিক্ষার্থী ও চাঁদপুরের তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার দাবি করেন তারা। সড়ক অবরোধ করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মুন্সী আবদুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর শান্তিনগরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। একই সময়ে সিদ্ধেশ্বরী ও উত্তরায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন।নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল বেলা ১১টার দিকে ফার্মগেট মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। হলিক্রস ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে অংশ নেন শতাধিক শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে এ সমাবেশ আরও বড় হয়। এ সময় সড়কে যানবাহন আটকে গাড়ির বৈধ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে কি-না তা দেখতে চান শিক্ষার্থীরা। এছাড়া একাধিক মোটরসাইকেলের কাগজপত্র না থাকায় কৈফিয়ত চান তারা এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে মামলার আবেদন করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে শিক্ষার্থীদের এই অবস্থান বিক্ষোভের ফলে ফার্মগেট এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে এই যানজট স্থায়ী থাকে। শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে রাজধানীর গুলিস্তান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শান্তিনগর, উত্তরা ও ফার্মগেটসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন। এ সময় ব্যস্ত সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মূল সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিক্ষোভ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজ্ঞান কলেজের এক শিক্ষককে নিয়ে পুলিশের একটি দল ছাত্রদেরকে বোঝাতে এলেও শিক্ষার্থীরা তাদের কথা শোনেননি। পরবর্তীতে তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যান। এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘মামা আস্তে গাড়ি চালান, মা-বাবা কাঁদে’, ‘আমরা বাঁচতে চাই, নিরাপদ সড়ক চাই’ ইত্যাদি স্লোগানে চারদিক মুখরিত হয়। সকাল থেকেই রাস্তা দখল করে শিক্ষার্থীদের অবরোধ চলাকালে প্রচণ্ড যানজটে সাধারণ মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। যানজটে আটকে পড়া মতিঝিলের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সালমা খাতুন রাজধানীর মনিপুরীপাড়ার বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর তিনি শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধে আটকা পড়েন। পরে হেঁটেই গন্তব্যে যান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারায় অনেকটা ক্ষুব্ধ হন আমিন। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পরে ভেবেছিলাম চাকরিটা হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সঠিক সময়ে পৌঁছানো গেল না। যদিও ওদের দাবি যৌক্তিক। এ সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন এই যুবক।দিনভর বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলায় গতকাল নগরীতে বাসের সংখ্যা ছিল অন্যদিনের চেয়ে কম। এতে কর্মক্ষেত্রে বের হয়ে অনেকেই ভোগান্তিতে পড়েন।