গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে করোনা রোগীরা

মানবজমিন প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০২১, ০০:০০

গ্রাম থেকে একের পর এক ছুটে আসছে এম্বুলেন্স। গন্তব্য রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল। এম্বুলেন্সে আসা রোগীদের কারও দরকার আইসিইউ। কারও দরকার হাই ফ্লো অক্সিজেন। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ খালি নেই। উচ্চ চাপের অক্সিজেন সুবিধাও সীমিত। তাই সব রোগীকে আসার পরই ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। এক হাসপাতাল থেকে পাঠানো হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন রোগীরা। ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে গ্রামে ফিরে যাওয়া রোগীর তথ্যও পাওয়া গেছে। করোনার দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বাড়ছে গুরুতর রোগীর সংখ্যা। গ্রামে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম। অনেক জেলা শহরে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় রোগী নিয়ে স্বজনরা ছুটছেন বিভাগীয় বা রাজধানী শহরে। গত দুইদিন ধরে রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে গ্রাম থেকে রোগী আসছেন বেশি। যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগের অবস্থাই সংকটাপন্ন। গত বুধবার দুপুরে মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে দেড় ঘণ্টায় ১৮ জন রোগী আসেন। তখন একসঙ্গে ১২টি এম্বুলেন্সের সারি ছিল জরুরি বিভাগের সামনে। ওই ১২টি এম্বুলেন্সই ঢাকার বাইরের জেলা থেকে রোগী নিয়ে আসে। এছাড়া দেড় ঘণ্টায় আসা ১৮ জন রোগীর সবাই ঢাকার বাইরের। এতদিন এই হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেয়া হতো না। কিন্তু বুধবার দুপুরে একজন রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া হয় অক্সিজেন সুবিধা না থাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের জরুরি বিভাগে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের মতো রোগী আসেন। তাদের ২০ জনের মতো ভর্তির সুযোগ পান। বাকি রোগীদের অন্য কোভিড ডেডিকেকেট হাসপাতালে রেফার করা হয়। ওই হাসপাতালে আসা ১১ জন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের ৯ জনই ঢাকার বাইরের অন্য জেলা থেকে এসেছেন। এসব রোগীর প্রায় সবার শ্বাসকষ্ট। তাদের কারও কারও আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে কোনো আইসিইউ খালি না থাকায় তাদের অন্য হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশিরভাগই রাজধানীর বাইরে থেকে আসা। এছাড়া মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আসা রোগীদের বড় অংশ ঢাকার বাইরের। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে দেড় ঘণ্টায় ১৮ রোগী, সবাই রাজধানীর বাইরের: রাজধানীসহ গোটা দেশের করোনা রোগীদের ভরসার স্থান ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল। প্রায় ৮০০ বেডের এই হাসপাতালে আছে পর্যাপ্ত সুযোগ- সুবিধা। কিন্তু রোগীর চাপে এই হাসপাতালেও এখন হিমশিম অবস্থা। মহাখালীর এ হাসপাতালটিতে সরজমিন বুধবার দুপুরে দেখা মেলে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ১২টি এম্বুলেন্স। সবক’টি রাজধানীর বাইরের থেকে আসা। দেড় ঘণ্টা অবস্থানে সেখানে মোট ১৮ জন রোগী আসেন। ১৫ জন এম্বুলেন্সযোগে আর তিনজন ব্যক্তিগত গাড়িতে। সব রোগীই এসেছেন রাজধানীর বাইরের জেলা থেকে। এর মাঝে দুইজন রোগীকে ফিরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও একজনকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালের অক্সিজেন সুবিধা ছাড়াই।গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন নিলয় বিশ্বাস। ঈদের দিন থেকে জ্বর সর্দিতে ভুগছিলেন তিনি। করোনা আক্রান্তের রিপোর্ট আসার পরেও বাড়িতেই সেবা নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়ে আসেন এই হাসপাতালে। বাইরে এস্বুলেন্সে অপেক্ষায় মা। ছেলে ও ভাই যান ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। তার অক্সিজেন লেবেল ৭০ থেকে ৭২। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর মিললো ভর্তির সুযোগ। স্ট্রেচার করে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ১২ দিন ধরে করোনা আক্রান্ত আমেনা বেগম। চাঁদপুরের এই বাসিন্দা দুইবার চাঁদপুরের হাসপাতালে চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারেননি। কাতারে থাকেন তার স্বামী। হাসপাতালের সামনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ভর্তির সুযোগ পান।তবে ১৮ রোগীর সবাই পাননি ভর্তির সুযোগ। কুমিল্লার হোমনা থেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন সাজ্জাদুর রহমান। হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও নেই অক্সিজেন সুবিধা। তাই ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি তাকে। রোগীর ভাই বাবু রহমান বলেন, তারা জানালো আপাতত সিট খালি নাই। কিছু সময় অপেক্ষা করেন একটা ব্যবস্থা হবে। ভাইকে এম্বুলেন্সেই রাখতে বলেন। যেহেতু অক্সিজেন ছাড়া চলছে না। এরপরও প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। ডাক্তাররা ব্যবস্থা করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা মেডিকেলের দিকে রওয়ানা হন তারা।আবার অক্সিজেন সুবিধা ছাড়াও ভর্তি হতে দেখা যায় রোগীদের। বরিশালের মঠবাড়িয়ার বাসিন্দা পারুল বেগম। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। সাতদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন বরিশাল হাসপাতালে। সেখানে অক্সিজেন সংকট হওয়ায় নিয়ে আসা হয় রাজধানীতে। কিন্তু হাসপাতালে নেই অক্সিজেন সুবিধা, শয্যা ফাঁকা থাকলেও। তার নাতি রুবেল বলেন, দাদির অবস্থা খুবই খারাপ। বরিশালে অক্সিজেন পাওয়া যায় না। হাসপাতালের অক্সিজেনের জন্য ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয়া লাগে। দাদির অক্সিজেন লেবেল নেমে আসে ৩০- এ। এখন এখানে এসে শুনি অক্সিজেন নাই। তারপরেও ভর্তি করাইলাম। ডাক্তাররা ফাঁকা হইলেই দেবে বললো। রুবেল বলেন, বাধ্য হয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনলাম। অন্য সময় এই সিলিন্ডারের দাম আট হাজার টাকা। আর এখন আমাদের কেনা লাগলো ২৫ হাজার টাকা দিয়ে। এই সিলিন্ডার আবার রিফিল করতে হবে। এখন অক্সিজেনসহ বেড পাওয়ার অপেক্ষায়। কবে পাবো জানি না। এখন পাইলে এই ২৫ হাজার টাকা নষ্ট। আর না পাইলে এটা বারবার রিফিল করতে হবে।আরেক রোগী আসেন মানিকগঞ্জ থেকে। এই বৃদ্ধার করোনা নেগেটিভ হওয়ায় ফিরিয়ে দেয়া হয় তাকে। চিকিৎসকের পরামর্শে স্বজনরা তাকে নিয়ে যান নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। তবে করোনা রোগীর পাশাপাশি হাসপাতালে দেখা মেলে করোনা পরবর্তী জটিলতা নিয়ে আসা রোগীদেরও। গত সোমবার সরজমিন দেখা যায়, এই হাসপাতালে এসেছিলেন শ্যামলী নামে এক রোগী। গতকাল দেড় ঘণ্টায় করোনা পরবর্তী জটিলতা নিয়ে আসা তিনজন রোগী মেলে। ছয়দিন হাসপাতালে থেকে ২২শে জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন আসলাম শেখ। ফরিদপুরের এই রোগী ফের এসেছেন। সাবেক শিক্ষক আসলাম শেখ বলেন, ছেলের মোটরসাইকেলে করে ঢাকা আসছি। বাস নাই এম্বুলেন্স ভাড়া চায় ৬-৮ হাজার টাকা। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ঘুমাইতে পারি না। শরীরের অনেক জায়গায় গোটা উঠছে। মাথার গুলা যন্ত্রণা করে খুব। শেষ রাতে জ্বর আসে। পেটে ক্ষুধা, খাইতে পারি না। পানীয় জাতীয় খাবার খেয়ে বেঁচে আছি। আর সব থেকে বড় সমস্যা এখন চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ডাক্তাররা বিভিন্ন পরামর্শ দিলো। আর সমস্যার জন্য অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছে। ডাক্তারটা খুব ভালো। আমার হাত ধরে বলে, চাচা চিন্তা করিয়েন না সব ভালো আপনার। আর এখানে সব করোনা রোগী। চেষ্টা করিয়েন আর না আসার। নইলে আবার আক্রান্ত হবেন। সোহরাওয়ার্দীতে ঢাকার বাইরের রোগী বেশি: একটু পরপর হাসপাতালের সামনে উচ্চস্বরে সাইরেন বাজিয়ে থামছে একের পর এক এম্বুলেন্স। পাশাপাশি রয়েছে রিকশা, সিএনজি। একাধিক ব্যক্তিগত গাড়িতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে অনেককে। সকলের গন্তব্য কোভিড ওয়ার্ড। বুধবার সকাল থেকে এমন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। জয়পুরহাট থেকে করোনা আক্রান্ত মকসুদ আলীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার দুই ছেলে এবং এক আত্মীয়। ভর্তির কার্যক্রম চলা অবস্থায় অক্সিজেন মাস্ক বদল করে নতুন মাস্ক দেয়ার দুই মিনিটের মাথায় মৃত্যু হয় তার। কথা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। মকসুদ আলীর ছেলে মাসুম জানায়, গত সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত হন মকসুদ আলী। বয়স ৬৫ বছর। আক্রান্ত হওয়ার পর শুরুর দিকে জ্বর ছাড়া অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা ছিল না। তিনদিন পরে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে ঘরের মেঝেতে পড়ে যান মকসুদ। এরপর থেকে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং ডায়রিয়া শুরু হয়। প্রথমে জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তৎক্ষণাৎ ঢাকার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মঙ্গলবার রাতে এম্বুলেন্সযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে গতকাল সকালে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে পৌঁছান। সকাল সাড়ে ১১টায় হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় অক্সিজেন মাস্ক দেয়ার দুই মিনিটের ভেতরে তিনি মারা যান। বরিশালের মুলাদী উপজেলার হোসনাবাদ থেকে করোনায় আক্রান্ত মেয়ে শাবানাকে নিয়ে এসেছেন মা মমতা বেগম। কথা হয় মমতার সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দৈনিক ঠিকা চুক্তিভিত্তিক আয়ার কাজ করেছি। সম্প্রতি মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণে ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না। মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলে সেখানে হঠাৎ তার পেটে ব্যথা এবং জ্বর শুরু হয়। প্রথম কয়েকদিন স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ালে জ্বর আরও বেড়ে যায়। পরবর্তীতে দেরি না করে ঢাকা নিয়ে আসি। মমতা বলেন, এক সময় এই হাসপাতালে চাকরি করলেও আজ মেয়েকে ভর্তি করাতে ওয়ার্ড মাস্টার, চিকিৎসকসহ নানাজনকে হাতে-পায়ে ধরে ভর্তির ব্যবস্থা হয়েছে। কোভিড ওয়ার্ডে শয্যা না থাকায় এখন মেঝেতে রেখে মেয়েকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ছোট মেয়ে শান্তাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করছেন মা রাজিয়া বেগম। কিশোরগঞ্জ থেকে করোনা আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে এসেছেন বলে জানান তিনি। কথা হয় রাজিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, শান্তা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। খাওয়া-দাওয়া কম করায় বয়সের তুলনায় অনেক রোগা দেখতে। অ্যাজমার সমস্যার কারণে কিছুদিন পরপরই শান্তাকে ফার্মেসি থেকে গ্যাস দিতে হয়। সম্প্রতি শান্তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে স্থানীয় ফার্মেসিতে গিয়ে গ্যাস দেয়া হলেও তার শ্বাসকষ্ট কমছিল না। পরবর্তীতে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে কোভিড টেস্ট করালে পজেটিভ আসে। গত মঙ্গলবার থেকে শান্তা অনেকটাই অজ্ঞান অবস্থায় আছে। এখন কিছুক্ষণ পরপর বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে শান্তার মায়ের কান্না থামছিল না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকে এখন বেশি রোগী আসছে। ঢাকার বাইরের রোগীদের সামলাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের বিষয়টি চিন্তা করে আমরা নতুন করে কোভিডের দুটি ওয়ার্ড বৃদ্ধি করেছি। প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। প্রতিদিন কতো রোগী ভর্তি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতকাল করোনা আক্রান্ত তিন শ’ রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us