গোয়াইনঘাটে নৃশংসতা নেপথ্যে কী

মানবজমিন প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০২১, ০০:০০

লোমহর্ষক, বর্বর ঘটনা ঘটেছে গোয়াইনঘাটের রাতারগুলের পার্শ্ববর্তী বিন্নাকান্দি গ্রামে। ঘুমন্ত অবস্থায় মা ও দুই সন্তানকে নির্মমভাবে জবাই করে ও শরীরে উপর্যুপরি কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে শিশু দু’টির পিতা হিফজুর রহমানকে। গতকাল সকালে হিফজুরের বসতঘর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এমন নৃশংস ঘটনায় হতবাক, স্তব্ধ গোয়াইনঘাটের মানুষ। বিরাজ করছে ক্ষোভও। গতকাল বিকাল পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি। দুটি ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। দুটোর মধ্যে রয়েছে একটি পারিবারিক ও অপরটি জমি সংক্রান্ত বিরোধ। হাসপাতালে ভর্তি থাকা হিফজুর রহমানের জ্ঞান ফিরলে রহস্য উদ্‌ঘাটন সম্ভব হবে বলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিলেটের এসপি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া হিফজুর রহমানের বাড়ি গোসাইপুর গ্রামে। তার পিতার নাম আব্দুর রব। স্ত্রী আলেয়া বেগম ও ১০ বছর বয়সী ছেলে মিজান ও ৩ বছর বয়সী মেয়ে তানিসাকে নিয়ে পিতার কাছে বসবাস করতেন। প্রায় ৫ বছর আগের ঘটনা। মামার বাড়ি বিন্নাকান্দি দক্ষিণপাড়া গ্রামে মায়ের সূত্র ধরে ৬-৭ ডিসিমেল জমি পান হিফজুর রহমান। এরপর তিনি ওই জমিতে ঘর বানিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছিলেন। এলাকায় পান-সুপারির ব্যবসা করেন হিফজুর রহমান। মাঝে মধ্যে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। বাড়ির লোকজন জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার রাতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে টিনশেডের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন হিফজুর। বেলা হয়ে গেলেও তারা দরোজা খুলছিলেন না। এ সময় আশেপাশের লোকজন তাদের ডাকাডাকি করলেও কোনো সাড়া মিলেনি। এ সময় স্থানীয় এক প্রতিবেশী ঘরের ভেতর থেকে  গোঙানির শব্দ শুনতে পান। এতে তার সন্দেহ হলে আশেপাশের লোকজন ডেকে আনেন। তারা এসে টোকা দিতেই দরোজা খুলে যায়। এ সময় তারা দেখতে পান ঘরের ভেতরে খাটের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে আলেয়া, মিজান ও তানিসার লাশ। তাদের সবার গলা কাটা। শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। খাট পুরোটাই রক্তাক্ত। বিছানাপত্রও রক্তাক্ত। গোটা ঘরে ছড়িয়ে আছে রক্ত আর রক্ত। এ দৃশ্য দেখে স্থানীয়রা চিৎকার শুরু করেন। বাড়ির পাশে সড়কেই উন্নয়ন কাজ করছিলেন স্থানীয় ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরী। চিৎকার শুনে তিনি বাড়ির দিকে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন খাটের উপর পড়ে আছে চারজনের দেহ। এ দৃশ্য দেখে তিনি পুলিশকে খবর দেন।  চেয়ারম্যান জানান, চারজনের দেহ পড়ে থাকার দৃশ্য তিনি যখন দেখছিলেন তখন হিফজুর রহমান চোখ মেলে তাকাচ্ছিলেন। তিনি এ সময় আন্দাজ করেন হিফজুর রহমান জীবিত। পুলিশ আসার অপেক্ষা না করেই তিনি হিফজুর রহমানকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। আলেয়া ও তার দুই সন্তানের কোনো সাড়া-শব্দ পাননি। এদিকে- খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ গিয়ে লাশ তিনটি উদ্ধার করে। স্থানীয় বরকত উল্লাহ জানিয়েছেন, আলেয়া ও তার দুই সন্তানের দেহ ছিল ক্ষত-বিক্ষত। নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের সবার গলা কাটা ছিল। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিল ধারালো অস্ত্রের  কোপানোর আঘাত। লাশ দেখে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে হিফজুর রহমানের পিতা ও ভাইয়েরা ছুটে আসেন বিন্নাকান্দি গ্রামে। ঘটনা শুনে তারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ এ সময় হিফজুরের বাড়িতে ভিড় জমান। এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভের পাশাপাশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। কী কারণে এমন নির্মম হত্যা- সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবাই। পাশের বাড়ির আজমল আলী জানিয়েছেন, হিফজুর রহমান খুবই নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কখনো কারও সঙ্গে তার বিরোধ ছিল না। সে পান-সুপারি বিক্রির পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতেন। ছেলের বউ ও নাতি-নাতনির লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন হিফজুরের পিতা আব্দুর রব। তিনি জানিয়েছেন, হিফজুরের ঘরের পাশে রয়েছে তার দুই মামার ঘর। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রায় সময়ই হিফজুরের সঙ্গে তাদের ঝগড়া হতো। এ নিয়ে গ্রামে কয়েক বার সালিশ বৈঠক হয়েছে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে এ কথা তো বলবে হিফজুরের মামারা। কারণ- তাদের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করতো হিফজুর। গ্রামের কিংবা এলাকার কারও সঙ্গে হিফজুরের কোনো বিরোধ ছিল না বলে দাবি করেন আব্দুর রব। সিলেটের গোয়াইনঘাট থানার ওসি আব্দুল আহাদ জানিয়েছেন, ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তার আগেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হিফজুর রহমানকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। খাটের উপর তারা গলাকাটা অবস্থায় তিনজনের লাশ পেয়েছেন। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এদিকে- খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যান সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন। এ সময় তিনি হিফজুরের মামা সুজাতুর রহমান সহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। লাশ উদ্ধারের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীরও কথা শোনেন। তবে- তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য মিলেনি। পুলিশ সুপারের ধারণা দুটি কারণে এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তদন্ত চলছে। পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পুলিশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে জমি সংক্রান্ত ও পারিবারিক বিরোধ। হিফজুর পুলিশের পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার জ্ঞান ফিরেনি। জ্ঞান ফিরার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেটের ডিআইজি মো. মফিজ উদ্দিন। তিনি সাংবাদিকদের জানান,  হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করে যাচ্ছে। কয়েকটি বিষয় মাথায় নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারবো বলে আমরা আশাবাদী। তিনি জানান, ভিকটিম হিফজুর যে ঘরে থাকতেন ওই ঘরটি তার মায়ের পৈতৃক সম্পত্তি  থেকে প্রাপ্ত। আর পাশের আরও দুটি ঘরে তার মামারা থাকতেন। হিফজুর দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের মামাসহ আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কাউকে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘটনার পর পুলিশ হিফজুরের মামা সুজাতুর রহমান সহ পরিবারের ৬ সদস্যকে বাড়ির একটি ঘরে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিকাল পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য মিলেনি। পুলিশের ধারণা- পারিবারিক বিরোধের জের ধরে হিফজুর রহমান নিজেও ঘটনার জন্ম দিতে পারেন। আবার পরকীয়া কিংবা জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বাইরে থেকে  কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে। কারণ- সকালে যখন এলাকার লোকজন দরোজায় টোকা দেন তখন তারা দেখেন ভেতরের সিটকিনি খোলা। ফলে ঘটনা ঘটিয়ে কেউ দরোজা খোলা রেখেই চলে যেতে পারে। তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন হবে বলে জানায় পুলিশ।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us