বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়নি। অল্পের জন্য মিস করেছি। আমার জন্মের পর এই দেশের জন্ম হয়েছে। সেই হিসাবে, জন্মসূত্রে আমি বাংলাদেশি নই। যারা ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, এটা মূলত তাদেরই দেশ। তারাই জন্মসূত্রে প্রকৃত বাংলাদেশি। আমার মতো যাদের জন্ম স্বাধীনতার আগে, তাদের কারও জন্ম পাকিস্তান রাষ্ট্রে, তারও আগে ভারত রাষ্ট্রে কিংবা ব্রিটিশ শাসিত ভারতে। রাজনৈতিক পরিক্রমায় মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারবেন না, ভবিষ্যতে কোনো মানচিত্র আবারও পরিবর্তিত হবে না। এই গ্রহে অনেক রাষ্ট্রের মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমরা যারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একটি দেশ পেয়েছি, সেই দেশের প্রতি আমাদের যে টান, তার চেয়ে অনেক বেশি টান থাকবে তাদের, যাদের জন্মই হয়েছে এই দেশে। আমরা কারা এই দেশ চেয়েছি আর কারা চাইনি- সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যাদের জন্মই হয়েছে এই দেশে, তাদের আর সেই বিতর্কের সুযোগ নেই। তারা আজন্ম বাংলাদেশি। তারা খাঁটি বাংলাদেশি। এটা তারা বুঝুক আর নাই বুঝুক- বাংলাই তাদের দেশ, এই মাটিই তাদের আপন, এই বাতাস তাদের জীবন, এই পানি তাদের প্রাণ, এই সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর খেলে যাওয়া নৃত্যই তাদের আনন্দ। এর বাইরে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে তাদের ভাবনার সুযোগ নেই। যদি এর বাইরে কেউ বিন্দুমাত্র কিছু ভাবে, তাহলে সে হবে ট্রেইটর- দেশদ্রোহী। এই পৃথিবীতে ট্রেইটেরর কোনো স্থান নেই, কোথাও নেই। একাত্তরের পরে যাদের জন্ম, তাদের কাছে দেশের সংজ্ঞা খুবই পরিস্কার। এই গ্রহের যেখানেই সে যাক, জন্মসূত্রে সে বাংলাদেশি। তাই তাদের বুঝতে হবে, তারা ট্রেইটর কিনা? তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো বিষয়টি নিয়ে ভাবে না। তাদের কাছে আমার একটি সোজা প্রশ্ন, তারা কি কেউ ট্রেইটর? একটি স্বাধীন দেশে হাজারো মতের মানুষ থাকবে। এটাই মানবতার সৌন্দর্য। কিন্তু দেশের স্বার্থে সবাই এক, কেবল ট্রেইটর ছাড়া। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে তারা যেন নিজেকে একবার হলেও এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করে- অ্যাম আই এ ট্রেইটর? ২. যে শিশুটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জন্মেছিল, তার এ বছর ২৬ মার্চে ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এমন মানুষ এই দেশে অনেক পাওয়া যাবে। আগামী ৯ মাস (১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) আরও কয়েক লাখ মানুষ হয়তো পঞ্চাশে পা দেবে। তাদের বয়সেই এই দেশটির বয়স। সেই হিসাবে বাংলাদেশ খুবই নতুন একটি দেশ। এই গ্রহে হাজার বছরের পুরোনো দেশ রয়েছে। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ এখনও শিশুতুল্য একটি দেশ। কিন্তু এই শিশুতুল্য দেশটিই এখন সেই বিগ ব্রাদারদের সঙ্গে টেক্কা দিতে চলেছে। উন্নয়নের সবক'টি সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে এই দেশের যা হাল ছিল, তার সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। আমি আমার দাদাকে দেখেছি, দাদার বাড়ি দেখেছি, আমার বাবাকে দেখেছি। বাংলাদেশের জন্মের প্রথম ১০ বছরের স্মৃতি আমার কাছে সেভাবে নেই। বিগত ৪০ বছরের অনেক কিছুই তো মনে আছে। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষের তিন বেলা ভালো খাবার জুটত না, একটি পোশাক দিয়েই বছর চালাতে হতো, কোনো ঈদে জামা-জুতা কেনা হতো, আবার কোনো ঈদে হতো না। এক জোড়া জুতা দিয়ে চলতে হতো বছরের পর বছর। আমার নিজের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেখেছি জুতা জোড়া পায়ে না দিয়ে হাতে করে বয়ে আনতেন এবং স্কুলের চাপকলে পা ধুয়ে তারপর জুতা পরে স্কুলে ঢুকতেন। আমাদের স্কুলের ওপরে টিন ছিল, চারপাশে বাঁশের বেড়া। সেই স্কুল, সেই জীবন যাপন এখন কি কেউ চিন্তা করতে পারে? বর্তমান প্রজন্মের মানুষ, যারা এই দেশের মালিক, তারা কি আসলেই সেই বাংলাদেশকে দেখতে পায়? সেই বাংলাদেশকে যদি কেউ দেখতে পায়, তাহলে দেখবে বাংলাদেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই জায়গায় দাঁড়িয়েছে। বিগত ৫০ বছরে দরিদ্রতা যেমন কেটে গেছে, আবার জনসংখ্যাও বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ। যদি বাংলাদেশ আজকের এই জায়গায় দাঁড়াতে না পারত, তাহলে হয়তো আমরা বুঝতাম, কত কঠিন জীবনই না ছিল আমাদের কপালে। সেই কঠিন সময় আমরা পার করে এসেছি। বাংলাদেশ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে পরের ধাপে যাওয়ার। একটি উন্নত দেশ হিসেবে এই বিশ্বের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। আমরা এখন হুট করেই যদি আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করি, ইংল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে এই নব্য দেশটির প্রতি অবিচার করা হবে বৈকি! বাংলাদেশ যে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, এটাই কেউ বিশ্বাস করত না। এই দেশে যাদের জন্ম, তারা এটুকু বুঝতে শিখুক- নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভালো করছে। তাদের দেশ ভালো করছে। এই অনুভূতি যদি কেউ অনুভব করতে পারে, তাহলেই সে সেটি বুঝতে পারবে। আর কোনো কিছু দিয়েই তাকে সেটি বুঝানো যাবে না। ৩. আমি আশা করেছিলাম স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তী খুব উৎসবমুখর হবে। সবাই মিলে এই বছরটায় সুখের গান গাইবে। হাসবে, খেলবে, উৎসব করবে, যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ পেয়েছি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, তাদের দুঃখগুলোকে কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়াবে- সর্বোপরি পুরো দেশে একটি ইতিবাচক বাতাস বইতে থাকবে। ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশকে স্বাধীন করার জন্য এই দেশের সিংহভাগ মানুষ এক হয়েছিল। আমি আশা করেছিলাম, এই পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সবাই দলমত নির্বিশেষে একসঙ্গে উৎসবে মাতবে, পথে আলপনা আঁকবে, হাত ধরে নাচবে, গলা ছেড়ে গাইবে- এটাই তো একটি দেশের চিত্র। পুরো বিশ্ব দেখবে, বাংলাদেশের মানুষ দেশের জন্য এক জায়গায় কীভাবে মিলিত হয়ে যায়। এরা বাংলাদেশি! কিন্তু আজ এই দেশে যা হলো, তাতে বাংলাদেশকে নতুন করে ভাবতে হবে। সুবর্ণজয়ন্তীতে এই দেশের মানুষ যেভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যেভাবে নিজেদের ভেতর ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, যেভাবে অবিশ্বাসের বিষ আরও নীল হচ্ছে, তাতে এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। একটি দেশে নানান মতবাদ থাকবে, নানান ধ্যান-ধারণা থাকবে। কিন্তু দেশের ৫০ বছর পূর্তিতে তো আমরা এক হবো! যদি এক হতে না পারি, তাহলেই বুঝতে হবে আমাদের মানুষের ভেতর চরম বিভেদ রয়েছে, যা আমরা অতিক্রম করতে পারিনি। এই জনসংখ্যা তো ছোট নয়! তাদের তো বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা এই মাটিরই মানুষ, তারা এখানেই থাকবে। তাদের সঙ্গে দূরত্ব এতটা বেড়ে গেলে সেখানে শান্তির সুবাতাস বইবে কীভাবে? আজ আমার ঘর-বাড়ি-গাড়ি সব হতে পারে। কিন্তু আমার মনে যদি শান্তি না থাকে, তাহলে তো সবই অর্থহীন। আমরা তো এই সবকিছুই করছি শান্তির জন্য, আমাদের সুখের জন্য। কিন্তু এত বিভেদ নিয়ে, বিদ্বেষ নিয়ে শান্তি হয় কীভাবে! এই যে পঞ্চশের নিচের বয়সী মানুষ, যাদের জন্মভূমিই হলো বাংলাদেশ, তারা যদি দেশকে না ভালোবাসেন, তারা যদি দেশের স্বার্থে একত্রিত হতে না পারেন, তাহলে এই দেশে কি আবারও বিরোধ লাগবে না? ঘরের ভেতরের সেই বিরোধ আমরা মেটাব কীভাবে! আরেকটি যুদ্ধ কি কেউ দেখতে পাচ্ছেন না? তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; কলাম লেখক [email protected]