মানুষ কিভাবে এত নিষ্ঠুর হতে পারে?

মানবজমিন প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক অতীতে দেশবাসীকে বেশ কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা অবলোকন করতে হয়েছে। সিলেট বন্দরবাজারে রহস্যজনকভাবে নিহত যুবক রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তাপ বিরাজ করছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ ফাঁড়িতে নির্দয় লাঠিপেটার ফলে উক্ত যুবকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, ময়নাতদন্তে নিহত যুবকের শরীরে ১১১ টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। উপড়ে গেছে, তার দু'টি আঙ্গুলের নখ। মনে করা হচ্ছে, আঘাতের পর আঘাতে শরীরের রক্তনালীসমুহ ফেটে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হাইপোভোলেমিক ও নিউরোজেনিক শকে তার মৃত্যু হয়েছে। কি ছিল তার অপরাধ? বলা হচ্ছে, ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এমন অভিযোগও উঠেছে, তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল। পুলিশী নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ সত্যি হয়ে থাকলে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, নিহত ব্যক্তি অপরাধী ছিলেন, তবুও কি পুলিশ তাকে এভাবে নির্যাতনের অধিকার রাখে?পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা এদেশে যে খুব নতুন কোন বিষয় তা কিন্তু নয়। বছরখানেক আগে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় 'ছেলে ধরা' সন্দেহে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে তাসলিমা নামে এক মধ্যবয়সী মহিলা গণপিটুনিতে নিহত হন। জানা যায়, ভদ্র মহিলা তার সন্তানের ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে ওখানে একটি স্কুলে গিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ব্যক্তি 'ছেলে ধরা' সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন। কিছু বিপথগামী ছাত্রনেতার নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে বুয়েট ছাত্র আবরারের মৃত্যুর ঘটনা ত এখনও তরতাজা। যদ্দুর মনে পড়ে, নব্বইয়ের দশকে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল রাজনৈতিক কর্মীর হাতে এভাবেই রাতভর পিটুনির শিকার হয়ে এক ছাত্র বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিল। সিলেটের ঘটনাটি একটু বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ, এ ঘটনাটি পুলিশের হাতে ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্ভবত আরেকটি কারণ, নিকট অতীতে দেশে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে, যার কোন কোনটিতে অভিযোগের তীর নিবদ্ধ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে।এই যে বেধড়ক পিটুনি, যা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা কি হত্যার উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে? রাস্তাঘাটে 'ছেলে-ধরা', পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারী সন্দেহে উচ্ছৃঙ্খল জনতা যখন কাউকে উড়ুম ধুড়ুম মার শুরু করে, তখন সেখানে আসলে কোন উদ্দেশ্য কাজ করে না। এটা স্রেফ অপরাধকান্ডের প্রতি মানুষের আক্রোশ, আইনি ব্যবস্থার প্রতি এক রকম অশ্রদ্ধা ও অনাস্থা। তবে, সেই সাথে এসব ঘটনায় মানুষ যে অনেক সময় কত অবিবেচক ও নিষ্ঠুর হতে পারে, তারও দেখা মেলে। আপনি খোঁজ নিলে হয়ত দেখবেন, যে লোকগুলো এভাবে একজনের উপর হামলে পড়েছে, তাদের বেশির ভাগই তেমন কিছু না জেনে স্রেফ হুজুগের বশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আর কে কার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে তার কসরৎ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমুহে যখন কিছু তথাকথিত ক্ষমতাধর ছাত্রনেতা কিংবা তাদের অনুগত ষন্ডা-পান্ডারা প্রতিপক্ষ বিবেচনায় কিংবা অন্য কোন কারণে একজন ছাত্রের ওপর হামলে পড়ে, নির্দয়ভাবে পিটুনি দেয়, তখন ঐ ক্ষমতা জাহির করাটাই অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে। তারা এভাবে নিজেদের পারফরম্যান্স দেখাতে চায়, 'বড় ভাই'দের নেক নজরে পড়তে চায়, সেই সাথে সাধারণ্যে একটি সিগন্যাল দিয়ে রাখতে চায়- তাদের সমঝে চলাটা কতটা জরুরি। অনেক সময় কৌশল থাকে, জন্মের মতো ধোলাই দেয়া, তবে মারা না পড়ে যেন। দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি মরে নাই বটে, তবে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। মারা পড়লে সমস্যা হল, চারিদিকে অনেক বেশি শোরগোল পড়ে যায়। তখন ঘটনা এমন মোড় নেয় যে, দুর্বৃত্তদের পালিয়ে বাঁচাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের বিরুদ্ধে এই যে মাঝে-মধ্যে অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন অপরাধীদের থানায় ধরে নিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠে তা যদি আসলেই সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে? এখানেও নিশ্চয়ই হত্যার উদ্দেশ্য কাজ করে না। হত্যাই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে পিটিয়ে মারতে হবে কেন? এদেশের মানুষ ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অনেক সমাজবিরোধীর মারা পড়ার খবর শুনে আসছে। এসব ক্ষেত্রে 'পিটুনি' অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে বলে কখনও শুনেছেন? তাহলে, আপনি ধরে নিতে পারেন, মৃত্যু এখানে পরিকল্পিত নয়, দুর্ঘটনা মাত্র। যেটা মাঝে-মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে যায়। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের পিটুনির দেয়ার অভিযোগ কদ্দুর সত্যি? আর কদ্দুর স্রেফ গুজব আর রটনা? সত্যি হয়ে থাকলে তা কি নিয়মিতই ঘটে? আর একজন মানুষকে কতটুকু নিষ্ঠুরভাবে পেটালে তা এমনকি মৃত্যু ডেকে আনতে পারে?যে বিযয়টি আমাকে বিশেষভাবে ভাবিত করছে তা হল, একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও সংবেদনশীল পুলিশ বাহিনীর কি আদৌ কোন বিকল্প আছে? দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোন উদ্যোগ ও স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও আমজনতার নিরাপত্তা বিধান ও সমাজ-বিরোধী দুর্বৃত্তদের দমনে পুলিশ বাহিনীই ত আমাদের শেষ ভরসা। অপরাধীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চয়ই যথেষ্ট ক্ষমতা দিতে হবে। তারা যাতে অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে পারেন, তজ্জন্য তারা যেন নিজেদের মত করে যথোচিত, কার্যকর কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন, সে স্বাধীনতাও অবশ্যই তাদের দেয়া জরুরি। কিন্তু, অপরাধী বা সন্দেহভাজন অপরাধীকে পুলিশ হেফাজতে নির্দয়ভাবে পেটানো কি পুলিশি কৌশল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু কিংবা নির্যাতনের মুখে মিথ্যা স্বীকারোক্তি প্রদানের যে সব অভিযোগ মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় আসছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রমাণিত হচ্ছে তা আইনের দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?মনুষ্য সমাজে ব্যথা-বেদনা, তা দৈহিকই হোক কিংবা মানসিক, মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে। খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে, মানুষ যত রকমের ওষুধ খায়, তন্মধ্যে ব্যথার ওষুধ একটা বড় অংশ দখল করে আছে। মানুষ যখন শারীরিক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, ব্যথা-বেদনায় কাৎরায়, তখন আশেপাশে যেই থাকুক ছুটে আসে, সমব্যথী হয়, যে যেভাবে পারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেখানে একজন মানুষকে পেটানো, পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা - এটা কোন মানুষের কাজ হতে পারে? এ কারণেই মানব সমাজে 'অমানুষ', 'নরপশু', 'নরপিশাচ' - এ সব শব্দের প্রচলন হয়েছে। যে কসাই প্রতিদিন কয়েকটা গরু-খাসি জবাই করে, কেটে টুকরো টুকরো করে, তাকে একজন মানুষের গায়ে একটা কোপ দিতে বলেন, তার হাত শুধু নয়, সারা শরীর, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে। কিন্তু, মানুষ যখন অমানুষ হয়ে যায়, অন্যের গায়ে হাত তুলতে, নির্যাতন-নিপীড়ন করতে, এমনকি তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে তার হাত এতটুকু কাঁপে না, তার হৃদয়ে কোন অনুভূতি হয় না, বরং এতে সে এক রকম বিকৃত, পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। মানুষের এই অমানুষে রূপান্তর একদিনে হয় না। অপরাধ জগতে কেউ যখন পা রাখতে শুরু করে, প্রথম প্রথম তার বিবেক হোঁচট খায়, বিদ্রোহ করে। তবে, ধীরে ধীরে সে এটার সাথে অভিযোজিত হতে থাকে, অপরাধবোধ দুর্বল হয়ে আসে, বিবেক মরে যায়। তখন তার কাছে আর অপরাধকে অপরাধ বলে মনে হয়না।বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, এ দেশের পুলিশ বাহিনীর বৃহত্তর অংশ জন-বান্ধব, সমাজ-হিতৈষী। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, জনগণের জানমাল রক্ষায় তাঁরা নীরবে অতুলনীয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ৯৯৯ কলে সাড়া দিয়ে তাঁরা যেভাবে অনেক নারীর ইজ্জত বাঁচিয়েছেন, তা তাদের জনবান্ধব ভূমিকার ছোট্ট একটি উদাহরণ। করোনা মহামারীর এ দুর্যোগকালে মানুষের সেবায় দেশের পুলিশ বাহিনী অকাতরে কাজ করে গেছেন, তা করতে গিয়ে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমনকি হাসি-মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। একটি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে, তারা কেন সামগ্রিকভাবে গুটি কতেক অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় কাঁধে নেবেন, দুর্নামের ভাগী হবেন? কাজেই, এটার একটা  আশু বিহিত হওয়া দরকার। এজন্য পুলিশ বাহিনীর কর্মকান্ড মনিটরিংয়ের একটা সিস্টেম চালুর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর স্বচ্ছ রেকর্ডধারী, বিচক্ষণ ও চৌকস সদস্য এবং পদস্থ সরকারি-বেসরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে সার্বক্ষণিক নজরদারি। অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন অপরাধীর ইন্টারোগেশন থেকে শুরু করে থানা পর্যায়ের সার্বিক কার্যক্রম সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে, যার রেকর্ড নিয়মিতভাবে সংরক্ষণ করা হবে এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট জমা দেয়া হবে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ যেন অহেতুক ভুয়া অভিযোগ তুলতে না পারে, তজ্জন্য বডি ক্যামেরার প্রচলন করা যেতে পারে। তবে, সবার উপরে যেটা দরকার, তা হল রাজনৈতিক সংকল্প। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উঠা সাম্প্রতিক অভিযোগসমুহের ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে দ্রুত সাড়া দিয়েছে, তাতে সরকারের সে সদিচ্ছা ও সংকল্প আছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এখানে, উল্লেখ করা যেতে পারে, সিনহা হত্যাকান্ডের পর পুরো একটি মাস জুড়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কোন রিপোর্ট আসেনি। এখান থেকেই বুঝা যায়, সরকারের যথাযথ পর্যায় থেকে যদি সিদ্ধান্তমূলক বার্তা যায়, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য।লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগ

প্রথম আলো | জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)
৪ সপ্তাহ, ১ দিন আগে

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us