শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলা ট্রিবিউন প্রকাশিত: ০১ জুলাই ২০২০, ০০:৪৮

বুধবার (১ জুলাই) শতবর্ষে বছরে পা দিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। মঙ্গলবার (৩০ জুন) ৯৯ বছর পূর্ণ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়টির। ২০২১ সালের ৩০ জুন একশ’ বছর পূর্ণ হবে। একশ’ বছরে পা দেওয়ার প্রথম দিন আজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপন করবে উচ্চ শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, নতুন নতুন নানা গবেষণা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই পরিচিতি পায় বেশি। আশা আকাঙ্ক্ষার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও তারা তাদের প্রত্যাশা নিয়েই তাকিয়ে আছেন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিসরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন। পতাকা উত্তোলন ও বেলুন ওড়ানোর পর সকাল ১১টায় অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে অনলাইন সভা করা হবে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনলাইন ভার্চুয়াল সভায় জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সংযুক্ত হয়ে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,প্রসঙ্গ: আন্দোলন ও সংগ্রাম’ শীর্ষক মূল বক্তব্য দেবেন।

স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নেটিজনেরা একে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলেও সম্বোধন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৯ বছর শেষ করে শতকের ঘরে পা দিচ্ছে আজ।

দিনটি উপলক্ষে ঢাবি উপাচার্য জানিয়েছেন, ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ২০২০ সালের এই দিনে ৯৯ বছর শেষ করে শতবর্ষে পা দিলো আমাদের এই চিরতরুণ প্রতিষ্ঠান। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লোক সমাবেশ এড়িয়ে প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীবিহীন স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আয়োজন নিঃসন্দেহে আনন্দ, প্রশান্তি ও স্বস্তির ঘাটতি অনস্বীকার্য। তবে মুজিববর্ষের এই অলোকসামান্য কালপর্বে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে, ‘বঙ্গবন্ধু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বাংলাদেশ নামক আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির দুই অন্তহীন প্রেরণা-উৎস।

ঢাবি উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে আমাদের অস্তিত্বপ্রতিম এই প্রতিষ্ঠান শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করবে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও একই বছর উদযাপিত হবে। তাই বছরটি হবে আমাদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা, সম্মান, আবেগ, অনুভূতির সংশ্লেষে গৌরবদীপ্ত ও স্মৃতি-ভাবুকতার বছর।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের অদম্য এই যাত্রা নিয়ে সংহতি এবং ক্ষোভ দুই আছে অনেকের মনে। ‘ঢাকা বিশব্ববিদ্যালয় দিবসের’ আয়োজন ভার্চুয়ালি পালন করা হবে। সেটা কতটা অংশগ্রহণমূলক করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচিত প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি এবং কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, রাজনীতি চর্চার ব্যাপ্তি না থাকায় প্রগতি নেই। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যয় নির্ধারণের জন্য সরকার ট্যাক্স নেয়। জনগণের টাকা নিয়ে সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলোই। এটার পেছনে খরচ করার নীতি যতক্ষণ না নিচ্ছে রাষ্ট্র, ততক্ষণ এরকমই হবে।’ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থই হলো ‘নতুন জ্ঞান’ সঞ্চয় করা। গবেষণা কাজ ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু সেজন্য অর্থ বরাদ্দ নাই। বিশ্ববিদ্যালয় এখন অন্যান্য জায়গার মতো পেশিশক্তি এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো করুণ পরিণতি হয়েছে।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেছেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান। তার মতে, নতুন নতুন গবেষণা এবং তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ফলাও করে প্রচার করতে হবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকেই জানেন না নতুন নতুন গবেষণার তথ্য। এগুলো মানুষের চর্চা এবং ব্যবহারে কাজে লাগতে পারে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো উপস্থাপনে এখনও অনেক ঘাটতি আছে। ১০০ বছরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তার এতগুলো বিভাগ এতগুলো কার্যক্রম, কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে বের হয়। এমনকি ছোট ঘটনা হলেও তা পত্রিকায় জায়গা করে নেয়। কিন্তু অনেক গবেষণার সাফল্য কিংবা খবর সামনে আসে না। আমার কাছে মনে হয়, এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জায়গা আরও বিস্তৃতি করা দরকার এবং একইসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে— এটাই আমি প্রত্যাশা রাখি। গবেষণার জায়গায় আমাদের বিশ্বমানের দিক থেকে আরও দায়িত্ববোধ থাকা দরকার আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর, যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি সুনাম অর্জন করতে পারে।’

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন সাদেকা হালিম মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় নারীর জন্য যোগ্য স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একমাত্র নির্বাচিত ডিন হিসেবে এখন আমি আছি। ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী জায়গায় আরও নারীদের আসার সুযোগ আছে।’

কেবল একটি বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখার অবকাশ নেই বলে মনে করেন একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও বর্তমানে গণযোগোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন। চিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়েই একটি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল এই বাংলার নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল একটি মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক শ্রেণির বিকাশ, যার ঐতিহাসিক মূল্য অনিঃশেষ। জাতির উচ্চশিক্ষার আয়ত্ত্বসাধ্য দ্বার উন্মোচন করার পাশাপাশি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে সব বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও এই জাতির যা কিছু অর্জন, ভালো-মন্দ, তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।’

শুরুতেই স্বায়ত্ত্বশাসিত মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবারিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই যাত্রা শুরু হলেও সেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যেনো বা‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’হয়ে উঠেছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিবর্তন হয়ে যায়। নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জন্য গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা এবং ক্রমহ্রাসমান মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার উপযোগী করে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। তবে ৯৯ বছরেও একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি ঢাবি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বাংলাদেশের সব সরকারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হস্তক্ষেপ করে আসছে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দর্শন এবং তার লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৯৯ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে— এটা পুরো বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন আশাবাদ তৈরি করতে পারতো, যদি এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন জ্ঞানচর্চা ও মতামত প্রকাশ, গবেষণা, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের খুব সামান্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানতম লক্ষ্য পূরণের কাজে ব্যয় করা হয়। দেশের এবং মানুষের স্বার্থে গবেষণা কাজকে অনেক সময় সরকারিভাবে বাধা দেওয়া হয়, ভৎসনা করা হয়, নিরুৎসাহিত করা হয়।’
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us