পরিবারকে দূরে রেখেই করোনার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন ৩০ চিকিৎসক
প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২০, ১৯:৫৮
দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর থেকে পর্যাক্রমে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেখানে সবাইকে করোনা আক্রান্ত রোগী থেকে দূরে থাকতে বলা হচ্ছে, সেখানে সংক্রমণ ঝুঁকি জেনেও চিকিৎসক ও নার্সরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আক্রান্তদের। এরূপ চাঁদপুরের ৩০ জনের একদল চিকিৎসক ঝুঁকি নিয়ে জেলার প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে কারোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরাও। এদের অনেকেই গত এক-দুই মাস ধরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারেননি। সেবাই ব্রত রয়েছেন তারা।
জানা যায়, চাঁদপুরে গত ২২ মে পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছে শতাধিক মানুষ। আক্রান্তদের বেশির ভাগই চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব রোগীদের সেবা দিতে চিকিৎসকরা একটানা সাত দিন করে থাকছেন হাসপাতালে। এরপর থাকতে হচ্ছে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে। কোনও কোনও চিকিৎসক দুই মাস ধরে পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে হাসপাতালেই রয়েছেন। চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সামান তালে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জামাল সালেহ উদ্দিনের নির্দেশনায় এই দুর্যোগকালে সদর হাসপাতালে চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছেন চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা। আর জেলার পুরো করোনা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয় তদারকি করছেন সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ। সদর হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন অন্তত ৩০ জন চিকিৎসক।এর মধ্যে করোনাকালে হাসপাতালের সার্বিক সেবা কার্যক্রম তদারকি করছেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম, বিএমএর সভাপতি ডা. এমএন হুদা, সহকারী পরিচালক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান।
এছাড়া বিএমএ সেক্রেটারি ডা. মাহমুদুন নবী মাসুমও এই দুর্যোগকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।রোগীর সেবায় জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং ফ্লু কর্নার সামলাচ্ছেন আরএমও ডা. এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেল, ডা. মো. নুর-ই-আলম মজুমদার, আরএমও ডা. আসিবুল আহসান চৌধুরী, ডা. আনিছুর রহমান, ডা. নাজমুল হক, ডা. মো. মিজানুর রহমান, ডা. সৈয়দ আহমদ কাজল, ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম খান, ডা. মো. আনিসুর রহমান সুফি, ডা. আনিসুর রহমান ও ডা. মো. মাহবুব আলী খান।তারা জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে।
২২ মে পর্যন্ত হাসপাতালের আইসোলেশনে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬০ জন রোগী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং স্ত্রী-সন্তানদের দূরে রেখে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।জেনালের হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, পাঁচটি টিমে ভাগ হয়ে তারা করোনা রোগীদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিন জন ডাক্তারের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিটি টিম একনাগাড়ে সাত দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৪ দিন তারা থাকেন কোয়ারেন্টিনে। কোয়ারেন্টিন শেষে আরও ৭ দিন বাসায় থাকার পর আবারও ফিরে আসেন করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে।
তৃতীয় টিমে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. আবু সালেহ মো. সিরাজুম মনীর, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন) ডা. এসএম হাসিনুর রহমান, রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডা. মো. নোমান হোসেন।চতুর্থ টিমে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম পাটওয়ারী, সহকারী অধ্যাপক (বায়োকেমিস্ট্রি) ডা. মো. খালেদ মোশারফ হোসেন ও ডা. মো. বাহারুল আজম ভূইয়া।পঞ্চম টিমে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি) ডা. মো. হারুন-অর-রশিদ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম ও মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক (ফিজিওলজি) ডা. মো. হামিন মেহবুব।চিকিৎসকরা জানান, খারাপ অবস্থা নিয়ে কেউ করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে জরুরি বিভাগে এলে তার নমুনা সংগ্রহ করে আইসোলেশনে ভর্তি করা হয়।
আর যাদের করোনার লক্ষণ আছে, কিন্তু তারা হাঁটা-চলা করতে পারেন—এমন রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাসায় আলাদা থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে মোবাইলেও তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। এছাড়া যাদের করোনা লক্ষণ নেই, তাদের জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে।সদর হাসপাতালের ডা. মো. নূর-ই-আলম মজুমদার বলেন, 'আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ডাক্তারদের বাসা এবং পরিবার ছেড়ে হোটেলে থাকতে হচ্ছে। গত দুই মাস ধরে আমি নিজেও স্ত্রী-সন্তান থেকে আলাদা রয়েছি।'
তিনি বলেন, ‘করোনার এই সময়ে ডিউটি করা ঝুঁকির। তবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।'হাসপাতালটির আরএমও ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, 'করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা প্রতিদিনই ৩০ থেকে ৪০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠাচ্ছি।'হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম বলেন, 'করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর মার্চ থেকেই আমরা ২৪ বেডবিশিষ্ট আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করি।
এখন আইসোলেশন ইউনিটটি অনেক সুন্দর করা হয়েছে—যেন রোগীরা আবাসনজনিত কোনও ধরনের সমস্যা অনুভব না করেন।’সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। তারপরও যতটুকু সম্ভব সেফটি নিয়ে চলতে হবে।' সদর হাসপাতালে আরও ১৩ জন ডাক্তার যুক্ত হবেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'তারা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ট্রেনিং নিচ্ছেন।'