দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে স্থলপথে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত ১৪ দিনের জন্য ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকায় বেনাপোল স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের পেট্রাপোলে আটকা পড়েছে তিন শতাধিক বাংলাদেশি। আটকে পড়া যাত্রীদের বেশিরভাগ রোগী ও শিক্ষার্থী।
২৬ এপ্রিল সকাল থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দু’দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার বন্ধ ছিল। তবে দু’দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আগামী ৯ মে পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সীমান্ত পথ বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘সরকারের নিষেধাজ্ঞায় সকাল থেকে কোনো যাত্রী ভারতে প্রবেশ করেনি। ভারত থেকেও কোনো যাত্রী বাংলাদেশে আসেনি। তবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ না থাকায় আমদানি-রপ্তানি ও বন্দর থেকে পণ্য খালাস সচল আছে।’
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব জানান, আটকে পড়া যাত্রীদের দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে নতুন কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে ভারতীয় ছাত্রদের বিষয়ে নির্দেশনা আসতে পারে।
বেনাপোল সীমান্তে মনিটরিংয়ের কী অবস্থা
দুই সপ্তাহের সীমান্ত বন্ধের নির্দেশনার প্রথম দিন ২৬ এপ্রিল। এ দিন বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করা মানেই সব কিছু পুরোপুরি বন্ধ থাকা নয়। প্রতিদিনই বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন দুই দেশের মানুষ--কেউ ফিরছেন, কেউ যাচ্ছেন। ব্যক্তি এবং যানবাহন উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের চলাচল রয়েছে।
বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কেএম তারিকুল ইসলাম বলেছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে সীমান্ত দিয়ে আসা মানুষ এবং যানবাহনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যারা ভারত থেকে ফিরে আসছেন তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরণটি ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশংকা থাকা সত্ত্বেও সীমান্তে আগত মানুষের নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।
যারাই আসছেন তারা ভারতে করা কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল নিয়ে আসছেন। এতে কারো ফল পজিটিভ হলেও, তাকে মানবিক কারণে দেশে প্রবেশের বিধান রাখা হয়েছে। যদিও নিয়ম আছে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে কেউ প্রবেশ করলে তাকে সীমান্ত থেকেই হাসপাতালে নিতে হবে।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১০ দিনে ৩৮০১ জনের প্রবেশ
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে গত ১৫ই এপ্রিল থেকে ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ১২ জন করোনা আক্রান্ত যাত্রী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের পুলিশ তত্ত্বাবধানে যশোর জেনারেল হাসপাতাল করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। গত ৯ দিনে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে দেশে ফিরেছেন ৩ হাজার ৮০১ জন বাংলাদেশি।
করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে আসা যাত্রীদের বেনাপোল ইমিগ্রেশনের স্বাস্থ্য বিভাগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ১২ জন যাত্রীর দেহে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতকারী পাসপোর্টধারী যাত্রীরা।
বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে অক্সিজেন আসা বন্ধ
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা তরল অক্সিজেন আসা বন্ধ হয়ে গেছে। গত ২১ এপ্রিলের পর থেকে আর কোনো অক্সিজেনবাহী গাড়ি স্থলবন্দরটি দিয়ে দেশে আসেনি বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল জলিল। বাংলাদেশে করোনার চিকিৎসার কাজে এ তরল অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়।
তিনি বলেন, ‘২১ এপ্রিলের আগে এক সপ্তাহে ৪৯৮ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়। সর্বশেষ ২১ এপ্রিল ৯৭ মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি করা হয়। এরপর থেকে এই স্থলবন্দর দিয়ে আর কোনো অক্সিজেন দেশে আসেনি।’
দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারত থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তির পর পালিয়ে যাওয়া ৭ করোনা রোগীকে পুলিশ ধরেছে। এ ব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানার পর পুলিশ বেনাপোল ইমিগ্রেশন থেকে সাতজনের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় তাদের ধরা হয়। তাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল সময়ের মধ্যে করোনা সংক্রমিত সাতজন যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন। তাঁরা যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা পালিয়ে যান। গতকাল রোববার বিষয়টি জানাজানি হয়। ভারতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ায় এই পালানোর বিষয়টি আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত বন্ধ
এর আগে ২৫ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সভায় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ দিনের জন্য স্থলপথে পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়া সব ধরনের লোক চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, "ভারতে যেহেতু করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে। তাই আমরা চাইছি, স্থলবন্দর ও সীমান্ত থেকে মানুষের যাতায়াত দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখার। এই সময়ে মানুষের যাতায়াত বন্ধ থাকলেও পণ্যবাহী যানবাহন চলবে।"
সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ভারতে প্রতিদিনই রেকর্ড
ভারতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুতে প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ২৫ এপ্রিল রোববারও দেশটিতে সংক্রমণ-মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড হয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটার শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, রোববার ভারতে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩১ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদিন দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৮০৬ জন।
ভারতে পাঁচ দিন ধরে তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তার আগে ১৫ এপ্রিল থেকে দেশটিতে প্রতিদিন দুই লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। আর ছয় দিন ধরে ভারতে দুই হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছেন।
ভারতীয় ধরন কী এবং এটি কতটা শক্তিশালী
যে কোনো ভাইরাসই ক্রমাগত নিজের ভেতরে নিজেই মিউটেশন ঘটাতে করতে থাকে অর্থাৎ নিজেকে বদলাতে থাকে, এবং তার ফলে একই ভাইরাসের নানা ধরন তৈরি হয়।
কত দ্রুত এবং কত দূর নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি ভারতে ছড়িয়েছে তার সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে যে মাত্রায় নমুনা পরীক্ষা করতে হয় তা এখনও ভারতে সম্ভব নয়। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩৬১টি নমুনা পরীক্ষায় ২২০টির মধ্যে নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়।
সংক্রামক রোগের তথ্য সংগ্রহ এবং আদান-প্রদানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা জিআইসএইড-এর ডাটাবেজ অনুসারে, এরই মধ্যে কমপক্ষে ২১টি দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয়েছে। যাতায়াতের কারণে ব্রিটেনেও করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি পাওয়া গেছে। ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১০৩ জন কোভিড রোগীর দেহে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ফলে, ভারত থেকে ব্রিটেনে ভ্রমণ প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা এখনও জানতে পারেননি যে ভারতে প্রথম শনাক্ত এই করোনাভাইরাসটি অন্যগুলোর তুলনায় দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় কিনা, বা এটির বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর কিনা।
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন